বাংলাদেশের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ এবং বিকাশের মধ্যে এক রকম বিজ্ঞাপন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রথম হামলাটি এসেছে নগদের তরফ থেকে। ছয় ছয়জন তারকাকে দিয়ে ছয়টি বিজ্ঞাপন বানিয়েছে নগদ। বিজ্ঞাপনের পেছনে ছিলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
আগ্রহী পাঠক চাইলে বিজ্ঞাপনগুলো আরেকদফা দেখে নিতে পারেন
০১ (মোশাররফ করিম)
০২ (জিয়াউল পলাশ)
০৩ (মিশু সাব্বির)
০৪ (শামীম সরকার)
০৫ (মুকিত জাকারিয়া)
০৬ (চঞ্চল চৌধুরী)
প্রচারের প্রথম দিন থেকেই মানুষের নজর কেড়েছে এ আধা ডজন বিজ্ঞাপন। কেউ কেউ বলেছেন – বিজ্ঞাপনে ফারুকীর ট্রেডমার্ক ফ্লেভার পাওয়া গেছে। কেউ বলেছেন – সেলিব্রিটিদের দিয়ে এমন বড়সড় আয়োজনের বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। তবে, ব্র্যান্ড এবং বিজ্ঞাপন নিয়ে যারা কাজ করেন, ভাবেন, আগ্রহ রাখেন তাদের অনেকে শুরুতেই নগদের ক্যাম্পেইনটির সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।
বিজ্ঞাপনে সরাসরি না বললেও, দৃশ্যে “বিশাল ক্যাশ”, বিশাল ক্যাশের কালার কম্পোজিশন, এবং “ব-তে বেকুব” সংযুক্তির কারণে বেশিরভাগ দর্শকই ধরে নিয়েছেন – বিকাশকে ইঙ্গিত করে এ বিজ্ঞাপন বানানো হয়েছে।
তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডকে ইঙ্গিত করে, আক্রমণ করে বিজ্ঞাপন আসতেই পারে। এ আর নতুন কী!
“কম্প্যারিটিভ অ্যাডভারটাইজমেন্ট” মার্কেটিং যুদ্ধের ইতিহাসের ১৯৫০-৬০ দশকেই দেখা গেছে।
নগদের এ ক্যাম্পেইন দেখে জনমতে যে অভিযোগটি বড় হয়ে উঠেছে তা হলো – বিজ্ঞাপনে আপনি কাকে বেকুব বললেন? আপনার সম্ভাব্য ভোক্তাকে? পটেনশিয়াল কাস্টমারকে ‘বোকা’ ট্যাগ দিয়ে আপনি কি সত্যিই তাদের নিজের পকেটে আনতে পারবেন?
এখানে সম্ভবতঃ নগদের ব্র্যান্ডিং টীম এবং ক্রিয়েটিভ টীমের মাঝে একটা কম্যুনিকেশন গ্যাপ হয়ে গেছে।
পত্রিকায় অবশ্য ফারুকী বেশ ঘটা করে বলেছেন –
“নগদ' টিম অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এই গল্পগুলো পর্দায় তুলে আনার জন্য কাজ করেছে। যে কারণে 'নগদ' টিমের সঙ্গে বসে আমরা শুটিং প্লান চূড়ান্ত করি। অন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিন ধরে দেশের সাধারণ মানুষকে 'বোকা' বানাচ্ছিল, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে জানানোর জন্য 'ব-তে বেকুব না হয়ে, ন-তে নগদ-এ' আসার গল্পগুলো তৈরি। বিজ্ঞাপন নির্মাণের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছি হাস্যরসাত্মকভাবে নগদের সেবার গুণাগুণ বুঝিয়ে দিতে। যেহেতু ছয়টি গল্পের ছয়টি চিত্র এবং দেশের নানা ধরনের মানুষকে উপস্থাপন করে এই বিজ্ঞাপনগুলো তৈরি হচ্ছে, তাই নাখালপাড়া থেকে শুরু হলো মোশাররফ করিমকে 'বোকা থেকে চালাক' বানানোর গল্প। ধুলা, ধোঁয়া, সবজির দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন জয়গায় শুটিং চলল। এরমধ্যে আগ্রহী জনতার ভিড় তো আছেই। এভাবে টানা প্রায় ১০ দিন শুটিং, এডিটিং, ভয়েস ওভার এবং অন্যান্য কাজে আরও বেশ কিছুদিন পার। এভাবে বিজ্ঞাপনগুলো আলোর মুখ দেখল আর 'ছয়জন বোকা' আস্তে আস্তে 'চালাক' হয়ে উঠলেন।”
ফারুকীর এ বক্তব্যের একটি জায়গায় নজর দেয়া যাক – “অন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিন ধরে দেশের সাধারণ মানুষকে 'বোকা' বানাচ্ছিল, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে জানানোর জন্য 'ব-তে বেকুব না হয়ে, ন-তে নগদ-এ' আসার গল্পগুলো তৈরি। বিজ্ঞাপন নির্মাণের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছি হাস্যরসাত্মকভাবে নগদের সেবার গুণাগুণ বুঝিয়ে দিতে”।
অন্য ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে সাধারণ মানুষকে বোকা বানাচ্ছিল, সেটা বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞাপনের ভ্যালু প্রপোজিশন বা পে-অফ লাইনে দুটি বিষয় উঠে আসে –
১) অন্যদের চেয়ে নগদে সাশ্রয়/লাভ বেশি
২) নগদে একাউন্ট খোলা খুবই সহজ
আবার দেখি, কোন বিজ্ঞাপনে কী বলা হচ্ছে –
নগদের পয়েন্ট অব ডিফারেন্স তুলে ধরা হয়েছে এভাবে
- ক্যাশ আউটে রেট বেশি (মোশাররফ করিম)
- বিদ্যুৎ বিল দিতে চার্জ কাটে (জিয়াউল পলাশ)
- কাউকে টাকা পাঠাতে চার্জ কাটে (মিশু সাব্বির)
- মোবাইল একাউন্টে টাকা জমালে লাভ কম (শামীম সরকার)
- অনলাইন শপিংয়ে শর্তের প্যাঁচ বেশি (মুকিত জাকারিয়া)
- নগদ সেরা রিচার্জ অফার দেয় (চঞ্চল চৌধুরী)
বাজারে সব অফারের রেট এক হবে না। কেউ কম, কেউ বেশি করবেই। এ কারণেই দাম ভিত্তিক প্রতিযোগিতা এবং সেগমেন্টেশন হরহামেশা দেখতে পাই। কিন্তু, এই যে পয়েন্ট অব ডিফারেন্সগুলো আমরা বিজ্ঞাপনে দেখতে পেলাম, সেখানে কি কোনো সুত্র আছে কীভাবে “অন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিন ধরে দেশের সাধারণ মানুষকে 'বোকা' বানাচ্ছিল”?
ছয়টি পয়েন্ট অব ডিফারেন্সের মধ্যে কেবল “অনলাইন শপিংয়ে শর্তের প্যাঁচ বেশি” – এ জায়গায় নগদ দেখাতে পারতো কীভাবে মারপ্যাঁচে অন্যরা সাধারণ মানুষকে বোকা বানাচ্ছে। এ সুযোগ হাতছাড়া করেছে নগদ।
২য় যে সুযোগটি নগদ লুফে নিতে পারেনি তা হলো, অন্য পাঁচটি পয়েন্টে স্পষ্টভাবে দেখা যায় নগদের সার্ভিস নিলে ভোক্তাদের নগদ লাভ বেশি। এই নগদ লাভের দিকে ফোকাস করলে বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য পরিস্কার হতো। কিন্তু সেটি হয়নি।
খুব আশ্চর্য্যজনকভাবে এ ক্যাম্পেইনের মূল বক্তব্য হয়ে গেছে “নগদে একাউন্ট খোলা সহজ”।
বিজ্ঞাপনে আমরা পেইন-টু-সল্যুশন প্রসেসের কথা বলি। কিন্তু, নগদের বিজ্ঞাপনগুলোর প্রথম যে অংশে বিজ্ঞাপনের চরিত্রগুলো ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে বেকুব গালি খাচ্ছিলেন, তাদের মূল ‘যন্ত্রনা’ কীসে? অন্য ব্র্যান্ডের ফাঁদ, জ্ঞানের অভাব (consumer knowledge), নাকি নগদে একাউন্ট খোলার ঝামেলা নিতে না চাওয়া? নগদে একাউন্ট খোলা কখনো কি ঝামেলার ছিল? সেই ঝামেলাকে কি এখন সহজ করা হয়েছে?
তাহলে কেন বিজ্ঞাপনে বারবার ঝামেলার কথা বলা হয়েছে?
- নগদে একাউন্ট খোলা তো খুব ঝামেলা… (মোশাররফ করিম)
- নগদে একাউন্ট খোলার ঝামেলা কে লইবো? (জিয়াউল পলাশ)
- একাউন্ট খুলতে কী না কী প্যারা খাইতে হইবো জানি… (মিশু সাব্বির)
- নগদে বেশি লাভ দেয়, কিন্তু একাউন্ট খোলার ঝামেলাটা? (শামীম সরকার)
- (নগদে) একাউন্ট খোলার ঝামেলা কে নিবে? (মুকিত জাকারিয়া)
- (নগদে) একাউন্ট খোলার ঝামেলার ভিতর আমি নাই। (চঞ্চল চৌধুরী)
প্রশ্ন – ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ভোক্তাদের মনে কি এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে নগদে একাউন্ট খোলা ঝামেলা? বাজার গবেষণা যদি এমন কিছু বলে থাকে তবে বিজ্ঞাপনের ‘বেকুব বেকুব বেকুব’ অংশটুকুর দরকার হতো না।
নগদের এ ক্যাম্পেইনে কোন সমস্যার নিরিখে কী সমাধান অফার করা হচ্ছে সে ব্যাপারটি একেবারেই ঘোলাটে হয়ে গেছে। এক্সিকিউশনের এ সমস্যার প্রধান কারণ – প্রতিযোগী ব্র্যান্ডকে আক্রমন করার প্রক্রিয়া। নগদে একাউন্ট খুলতে ঝামেলা নেই – এমন কথা বলার জন্য “যে কোনো মোবাইল থেকে স্টার ওয়ান সিক্স সেভেন ডায়াল করুন”ই যথেষ্ঠ ছিল। নগদের সার্ভিস নিলে ভোক্তাদের নগদ লাভ কীভাবে বেশি হয় সে নিয়ে আলাদা কম্পারিটিভ বিজ্ঞাপন হতে পারতো।
বোকাকে বুদ্ধিমান বানানোর চমৎকার একটি বিজ্ঞাপন এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। ১৪-১৫ বছর আগে একটেলের ইজিলোডের বিজ্ঞাপনটি খুব সম্ভবতঃ ফারুকীরই করা –
ছয়জন তারকা নিয়ে বিশাল আয়োজনের ক্যাম্পেইনের বড় খুঁতটির কথা নেটিজেনরা ইতোমধ্যে তুলে ধরেছেন, বলেছেন – কম্পারিটিভ বিজ্ঞাপনে আপনার সম্ভাব্য কাস্টমারকে আক্রমন (অপমান) করবেন না, প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডকে আক্রমন করবেন।
এখানে আরও একটি প্রসঙ্গ যোগ করা প্রয়োজন। কম্পারিটিভ বিজ্ঞাপনের খুব উল্লেখযোগ্য একটি মন্ত্র হচ্ছে – যে বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আক্রমণ করবেন – সে বিষয়টি (কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ) বা সুবিধাটি যেন আপনি দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখতে পারেন। তাহলে, নগদ যে বলছে “কাগজপত্র বা ফরম ফিল আপের ঝামেলা ছাড়াই যে কোনো মোবাইল ফোন নাম্বার থেকে”… একাউন্ট খুলুন, এটা কি নগদের ইউনিক কোনো ফিচার? অন্য ব্র্যান্ডগুলো কি চাইলে এ সুবিধা অফার করতে পারে না?
এবার রাখি জরুরী একটি জিজ্ঞাসা –
বিজ্ঞাপনে সেলিব্রিটি নেয়ার ক্ষেত্রে সেলিব্রিটি ব্র্যান্ড কনগ্রুয়েন্সের কথা বলা হয়। ব্র্যান্ড এবং সেলিব্রিটির পার্সোনালিটি যেন মিল থাকে – সেদিকে নজর দিতে বলা হয়।
এই যে ছয়জন সেলিব্রিটি – এদের পার্সোনালিটি (ব্যক্তিগত জীবন এবং অভিনয় জীবন দুটো মিলিয়েই) কতোটুকু বোকা বোকা? চঞ্চল চৌধুরী কিংবা মোশাররফ করিম নিজেরাই ব্র্যান্ড। তাদের ইমেজের সঙ্গে ‘বেকুব’ কি খাপ খায়?
বাকী চারজন খুব জনপ্রিয় এবং হাল আমলের “ব্যাচেলর পয়েন্ট” বা “ফ্যামিলি ক্রাইসিস” নাটকে তাদের উপস্থিতি দর্শকের মনে এখনো তরতাজা। সেখানে কি এ চারজনের ব্যক্তিত্বে বেকুবি দেখা গেছে?
সব মিলিয়ে সেলিব্রিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইমেজ কনগ্রুয়েন্সের ঘাটতি নগদের বিজ্ঞাপনে সুস্পষ্ট।
***
নগদের এমন ক্যাম্পেইনের পর বিকাশ কী করে সেটি দেখার জন্য অনেকে অপেক্ষায় ছিলেন। কেউ কেউ বলেছিলেন – “ন-তে ননসেন্স না হয় ব-তে বুদ্ধিমান হোন” এমন কিছু বিকাশ বলবে।
আবার কেউ কেউ বলেছিলেন – “ব-তে বাংলা, বিশ্বাস, বিক্যাশ” এমন কিছু আসতে পারে।
দ্বিতীয় ধারণাটিই সত্যি হয়েছে –
বিকাশের এমন ঠান্ডা মাথার বিজ্ঞাপন প্রশংসিত হয়েছে। বিজ্ঞাপন যুদ্ধে এ মুহূর্তে বিকাশ দুই ধাপ এগিয়ে থাকলো।
*
তবে, যুদ্ধের দামামা বোধ হয় অন্যখানেও চলছে।
সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলের সংবাদ বিশ্লেষণমূলক এক অনুষ্ঠানে বিকাশের বিরুদ্ধে বেশ বড়সড় এক অভিযোগ এসেছে। সে অভিযোগের নিশ্চয় তদন্ত হবে। সত্যতা প্রমাণ পেলে প্রতিযোগিতায় বিকাশ কতোটুকু টিকে থাকতে পারবে সেটিই দেখার বিষয়।
*
বাংলাদেশের ডিজিট্যাল ফিন্যানসিয়াল সার্ভিসের সম্ভাবনা ব্যাপক।
এখানে যেমন সেবা এবং বিস্তৃতির ব্যাপক সুযোগ আছে, আছে বিজ্ঞাপন এবং যোগাযোগে নতুনত্ব নিয়ে আসার দরজা। প্রতারকদের কারণে গোপন কোড প্রকাশ করে অনেক গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; এমন অভিযোগ অনেকদিনের। ফলে, ব্র্যান্ডগুলোকে নিজেদের সার্ভিস প্রচারের পাশাপাশি ভোক্তাদের সচেতন করার কাজও করতে হচ্ছে।
সুস্থ প্রতিযোগিতা, স্বচ্ছ সেবাই পারে ডিজিট্যাল ফিন্যানসিয়াল সার্ভিসের ব্র্যান্ডগুলোকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যেতে। গ্রাহক সেবাকে প্রধান প্রতিপাদ্য করে নিজেকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব মার্কেটের লিডিং পজিশনে থাকা ব্র্যান্ডগুলোর কাঁধেই বেশি থাকে। তাই নগদ এবং বিকাশের ব্র্যান্ডিং যারা দেখেন তারা দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা-ভাবনা করবেন; এমনটিই আশা।
***
নোট –
বিজ্ঞামনের এ লেখা মূলতঃ বিজ্ঞাপন পর্যালোচনাভিত্তিক প্রয়াস। বিকাশ বা নগদের সঙ্গে বিজ্ঞামনের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক নেই। বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নেই।
No comments:
Post a Comment