“নামলে বিমান
রানওয়ের মসৃণে, বোয়িং কিম্বা রুস্কি ইলেউসিন, ককপিট থেকে পাইলট বুঝে নেন, এসে
গেল তারও তোমাকে দেখার দিন।” ওপার বাংলার জনপ্রিয় গায়ক, এক
সময়কার সাংবাদিক, সুমন চট্টোপাধ্যায়, অধুনা কবীর সুমন গানে সুরে প্রিয় মানুষকে
দেখার বিবরণে বলেছেন - কেবল জলে স্থলে নয়, আকাশ থেকে বিমান রানওয়েতে মাটি স্পর্শ
করলে ককপিটে বসে পাইলট অনুভব করেন, প্রিয়তমাকে দেখার দিন এসে গেছে।
অথচ
পরিসংখ্যান বলছে - ২০১৩-২০১৭, এ পাঁচ বছরে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও
আন্তর্জাতিক রুটে প্রায় ৩৭৩৭টি বিমান রানওয়েতে নামার সময় কিংবা আগেই দূর্ঘটনার কবলে
পড়েছে। ব্যুরো অভ এয়ারক্রাফট
অ্যাক্সিডেন্টস আর্কাইভে দেখা যায়, ১৯৪৪ সালে সর্বাধিক ৯৩৯টি এবং ১৯১৮ সালে সর্বনিম্ন ১২টি বিমান দূর্ঘটনা ঘটেছিল।
কেবল ২০১৮ সালেই, ২২শে নভেম্বর পর্যন্ত, ৮৯টি বিমান দূর্ঘটনা ঘটেছে।
কেন ঘটে দূর্ঘটনা?
অনুসন্ধান
প্রতিবেদন মতে, এসব দূর্ঘটনার প্রায় অর্ধেকের পেছনে রয়েছে পাইলটের ভুল-ত্রুটি।
কোনো সময় এসব ভুল নিতান্তই পাইলটের অদক্ষতা কিংবা অসতর্কতা থেকে সৃষ্ট, আবার কোনো
সময় পাইলট আবহাওয়া এবং কারিগরী দিক বিশ্লেষণে ভুল করে দূর্ঘটনায় পতিত হয়। প্রধানতঃ
প্রতিকূল আবহাওয়া, কারিগরী ত্রুটি, পাইলটের অদক্ষতা ছাড়াও সন্ত্রাসী আক্রমন এবং
বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টায় অনেক সময় বিমান দূর্ঘটনা ঘটে। একেবারে তুচ্ছ নয়, উড়ন্তপাখির সঙ্গে ধাক্কা লেগেও দূর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে, পাইলটের
দক্ষতায় কিংবা ভাগ্যের জোরে জরুরী অবতরণে প্রাণে বেঁচে যায় সবাই, নয়তো বিধ্বস্ত
হওয়াই হয় নিয়তি।
ব্ল্যাক বক্সের সন্ধানে
বিমান
দূর্ঘটনার পর উদ্ধারকারী দল প্রথমেই যত দ্রুত সম্ভব আহত যাত্রীদের নিরাপদে সরিয়ে
নিতে চেষ্টা করে। দূর্ঘটনার পর আগুন লেগে গেলে, যা প্রায়ই ঘটে, আগুন নিয়ন্ত্রণে
আনার চেষ্টা করা হয়। এরপর উদ্ধারকারীদল যে বস্তুটির অনুসন্ধান করেন তার নাম
ব্ল্যাক বক্স।
অস্ট্রেলিয়ান
বিজ্ঞানী ডেভিড ওয়ারেন ১৯৫০ এর দশকের শেষভাগে ব্ল্যাক বক্স উদ্ভাবন করেন। নামে
ব্ল্যাক হলেও, বক্সটি কালো রঙের নয়। ব্ল্যাক বক্স মূলতঃ উজ্জ্বল কমলা রঙের। বক্সটিকে ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বা
ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার নামেও ডাকা হয়। বিমানের যাত্রাকালীন সময়ের সকল তথ্য এ
রেকর্ডারে সংরক্ষিত হয়। ব্ল্যাক বক্স এমন কারিগরী নকশায় তৈরি করা হয় যে তীব্র
তাপমাত্রায় দহনে কিংবা পানিতেও এর ভেতরের রেকর্ডকৃত তথ্য থাকে অক্ষুণ্ণ। তাই
অনুসন্ধানকারী দল দূর্ঘটনা কবলিত বিমানের ব্ল্যাক বক্স উদ্ধারের চেষ্টা চালায়।
বিমান
দূর্ঘটনার আগ মুহূর্তগুলোয় পাইলট, সেকেন্ড অফিসার এবং কেবিন ক্রুদের মধ্যে কী কী
আলাপ হয়েছিল, বিমানের কারিগরী দিক কিংবা আবহাওয়ার অবস্থা কেমন ছিল সে সংক্রান্ত
যাবতীয় তথ্য ব্ল্যাক বক্স থেকে উদ্ধার করা হয়। দূর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ
এবং ভবিষ্যৎ সতর্কতার নিরিখে ব্ল্যাক বক্সই অনেক সময় শেষ ভরসা হয়ে ওঠে।
কারিগরী ত্রুটি বনাম মানবিক ভুল
বিমান
দূর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে এমন একটি ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, শতকরা ৫৬ ভাগ
দূর্ঘটনার পেছনে দায়ী থাকেন পাইলট, ১৭ ভাগ দূর্ঘটনা ঘটে কারিগরী ত্রুটির কারণে এবং
১৩ ভাগ দূর্ঘটনা ঘটে বৈরী আবহাওয়ায়। এছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণ জনিত সমস্যা, এয়ার
ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের দূর্বলতা, ছিনতাই চেষ্টাসহ প্রভৃতি কারণে বিমান
দূর্ঘটনা ঘটে।
প্রশ্ন
হচ্ছে, এই যে অর্ধেকের বেশি দূর্ঘটনার জন্য পাইলটের ভূমিকাকে দায়ী করা হচ্ছে তার
পেছনের কারণগুলো কী কী? এ কি পাইলটের অদক্ষতা, অবহেলা, অসতর্কতা নাকি অতিমাত্রার
আত্মবিশ্বাসের পরিণতি? ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির ম্যাগাজিন দ্য
সাইকোলজিস্ট-এর ২০১৪ সালের ফ্রেব্রুয়ারী সংখ্যায় ডন হ্যারিস লিখেছেন প্রশিক্ষণ
ঘাটতি, অতিরিক্ত ভ্রমণজনিত ক্লান্তি, অবসাদ, ব্যক্তিগত হতাশা এবং পেশাগত জীবনের
সমস্যাসহ নানারকম সংকটের কারণে বিমান দূর্ঘটনা ঘটে।
তবে কারিগরী এবং মানবিক ভুলের
বাইরে গিয়ে বিমান দূর্ঘটনার পেছনে ‘ককপিট কালচার’ ধারণার বিশ্লেষণ করেন
ব্রিটিশ-ক্যানাডিয়ান সাংবাদিক লেখক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল।
২০০৮ সালে প্রকাশিত
‘আউটলায়ার্স’ বইতে তিনি ১৯৯০ সালে এভিয়ানকা এয়ারলাইনস এবং ১৯৯৭ সালে কোরিয়ান
এয়ারলাইনস দূর্ঘটনার খুটিনাটি দিক তুলে ধরে দেখান, জাতিগত সংস্কৃতি এবং ককপিটে
পাইলটের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক-ব্যবধানের কারণে বিমান দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের আউটলায়ারের প্রচ্ছদ |
এভিয়ানকা ফ্লাইট নম্বর ০৫২
কলম্বিয়ার
এভিয়ানকা এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটি ১৯৯০ সালের ২৫শে জানুয়ারী কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা
থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের কেনেডি এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথা ছিল। সেদিন আমেরিকার
আবহাওয়া এমন বৈরী ছিল যে বিভিন্ন এয়ারপোর্টে প্রায় পাঁচ শতাধিক ফ্লাইট যথা সময়ে না
ছেড়ে আবহাওয়া অনুকূলে আসার অপেক্ষায় ছিল।
নিউ ইয়র্কের
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল অফিস পরপর তিনবার এভিয়ানকাকে অবতরণে নিষেধ করে। নামার সংকেত
না পেয়ে বিমানটি ভার্জিনিয়ার আকাশে ১৯ মিনিট, আটলান্টিক শহরের ওপর ২৯ মিনিট এবং
কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণের আকাশে আরো ২৯ মিনিট চক্কর মারে।
প্রায়
সোয়া এক ঘন্টা এরকম আকাশে চক্কর দেয়ার পর অবশেষে এভিয়ানকা ফ্লাইটটি অবতরণের সবুজ
সংকেত পায়। পাইলট যখন শেষমেষ নিচে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন আচমকা বাতাসের
তীব্রতা এমনই বেড়ে যায় যে বিমান নিয়ন্ত্রণে রাখাই ছিল কঠিন। বাতাস সামাল দিতে বিমানের গতি বাড়িয়ে
দেয়া হয়। কিন্তু, হুট করে বাতাসের গতিবেগ অনেক কমে যায়, তখনো বিমানের গতি ছিল
স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এরকম সংকটকালীন পরিস্থিতিতে বিমান সাধারণত অটোপাইলটের
নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। দূর্ভাগ্যবশতঃ
এভিয়ানকা ০৫২ ফ্লাইটের
অটোপাইলট প্রযুক্তি কাজ করছিল না তখন। পাইলট বিমানকে ওপরে তোলার চেষ্টা করলেন। সফল হয়ে লং আইল্যান্ড এলাকার আকাশে
বিমান একবার চক্কর দিলো। কিন্তু তারপর হঠাৎ করে বিমানেরর একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে
গেল, কয়েক সেকেন্ড পর দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও!
“রানওয়ে
কোন দিকে?” পাইলট চিৎকার করে উঠলেন।
নিরাপদে
অবতরণের আশায় বিমান নিচে নামিয়ে দিলেন, কিন্তু কেনেডি এয়ারপোর্ট তখনো ১৬ মাইল
দূরে! লং আইল্যান্ডের কাভ নেক নামের ছোট্ট গ্রামে বিমানটি আছড়ে পড়ে। নয়জন ক্রুর
আটজন এবং ১৪৯ জন যাত্রীর ৭৩ জন মারা যায়।
কোরিয়ান এয়ার ফ্লাইট ৮০১
১৯৯৭
সালের ৫ আগস্ট স্থানীয় সময় রাত ৮টা ৫৩ মিনিটে কোনো প্রকার ঝুট ঝামেলা ছাড়াই
কোরিয়ান এয়ার ফ্লাইট নম্বর ৮০১ কোরিয়ার সিওল-কিম্পু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে
আমেরিকার গুয়ামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
বিমানের
যন্ত্রপাতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। এমনকি কোরিয়ান এয়ার তখন কোরিয়ার
প্রেসিডেন্সিয়াল বিমান হিসাবে পরিচিত ছিল। যাত্রাপথে সব ঠিকঠাকই ছিল। রাত ১টা ৩০
মিনিটে, ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ৬ আগস্ট, মেঘের ভেতর থেকে বিমান বেরিয়ে এলো।
ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার দূরে আলোকচ্ছটা দেখতে পাচ্ছিল।
বাইরে
বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। ক্যাপ্টেন তার সহকর্মীদের বলছিল, এর আগে আরো আট বার কিম্পু
থেকে গুয়াম এসেছে সে। সর্বশেষ
এসেছিল এক মাস আগে, ফলে গুয়াম এয়ারপোর্টের আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি তার জানা আছে।
রাত ১টা
৪১ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডে ফ্লাইট অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন গ্রাউন্ড প্রক্সিমিটি
ওয়ার্ণিং সিস্টেম বার্তা দিলো – মাটি এখনো ৫০০ ফুট নিচে! সবাই অবাক হয়ে গেল।
রাত ১টা
৪২ মিনিট ১৯ সেকেন্ডে ফার্স্ট অফিসার বিমান আবার ওপরে চক্কর দেয়ার প্রস্তাব করলো।
তিন
সেকেন্ড পর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারও ফার্স্ট অফিসারের প্রস্তাবে গলা মেলালো।
এর ঠিক
এক সেকেন্ড পর ক্যাপ্টেনও একই কথা বললো। কিন্তু বিমানটিকে কোনোভাবেই ওপরে উঠানো
গেল না।
রাত ১টা
৪২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে বিমানটি নিমিৎজ পাহাড়ে ধাক্কা লেগে বিধ্বস্ত হলো। এরপর প্রায়
দুই হাজার ফুট গভীরে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়লো।
বিমানের
আঘাতে সেখানকার তেলের পাইপ লাইন ফেটে গেল। বিশাল বিস্ফোরণে পুরো বিমানের শরীরে
দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠলো। উদ্ধারকারী দল যতক্ষণে পৌঁছালো, ততক্ষণে ২৫৪ জন আরোহীর
২২৮ জন মারা গেছে ঘটনাস্থলে।
বিধ্বস্ত কোরিয়ান এয়ার ৮০১ |
কী ছিল ব্ল্যাক বক্সে?
এভিয়ানকা
এয়ার এবং কোরিয়ান এয়ারলাইনসের দুটি ফ্লাইটেরই ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছিল।
ব্ল্যাক বক্সে রেকর্ডকৃত ডাটা উদ্ধার করে জানা গিয়েছিল কী ঘটেছিল বিমানের
অভ্যন্তরে, কী কী আলাপ হয়েছিল পাইলট এবং তার সহকর্মীদের মাঝে।
এভিয়ানকা
এয়ারের ক্ষেত্রে খারাপ আবহাওয়ার কারণে অবতরণে দেরী হচ্ছিল। প্রায় সোয়া এক ঘন্টা
বাড়তি সময় আকাশে চক্কর খেয়েছে। এসময় বিমানের জ্বালানী ফুরিয়ে আসছিলো। পাইলট তার সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছে।
নিউ ইয়র্কের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল অফিসকেও জানানো হয়েছিল। দূর্ঘটনার কারণ নিয়ে
প্রকাশিত প্রতিবেদনে খারাপ আবহাওয়ার পাশাপাশি জ্বালানী সংকটে বিমানের ইঞ্জিন বিকল
হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
কোরিয়ান
এয়ারের ক্ষেত্রেও প্রতিকূল আবহাওয়া, অফলাইন ওয়ার্ণিং সিস্টেম এবং অনেক পুরনো
ম্যাপকে দায়ী করা হয়েছে। এটাও বলা হয়েছে যে বিমানের পাইলট এবং তার সহকর্মীরা গুয়াম
এয়ারপোর্টের সঠিক অবস্থান অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে। বেঁচে যাওয়া কেবিন ক্রুদের
স্বাক্ষ্যবয়ান এবং ব্ল্যাক বক্স থেকে উদ্ধার করা তথ্যের ভিত্তিতে এসব সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়েছে।
উল্লেখ
করা প্রয়োজন যে দুটি ফ্লাইটেরই পাইলটের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল
না।
প্রচলিত
ধারণের বাইরে গিয়ে লেখক সাংবাদিক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল এ দুটি বিমানের ব্ল্যাক
বক্সে রেকর্ডকৃত সব কথাবার্তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে
দূর্ঘটনাগুলোর অন্যতম মূল কারণ হলো – ককপিট কালচার।
ককপিট কালচার, কতোটা শক্তিশালী?
ককপিট
কালচার বলতে মূলতঃ বিমানের অভ্যন্তরে পাইলট, ফার্স্ট অফিসার, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার
এবং অন্যান্য কেবিন ক্রুদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ, সৌহার্দ্য, বিনয় এবং সামগ্রিক
কর্মপরিবেশের প্রতি ইংগিত করা হয়।
এ কথা
অনস্বীকার্য যে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিতে পারস্পরিক যোগাযোগের ধরণে ভিন্নতা রয়েছে। এশিয়ান কালচারের কথাই ধরা যাক, এখানে বয়স এবং
পদবীর পার্থক্যকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেয়া হয়। ফলে, বয়সে কিংবা পদবীতে বড়
এমন মানুষের সঙ্গে আলাপে লোকজন বিনয়-নম্রতা এবং একরকম আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে।
এগুলো সাংস্কৃতিকভাবে মানুষ ছোটবেলাতেই শেখে যে বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে হয় না।
কর্মক্ষেত্রেও বড়কর্তাকে সমীহ করে চলা অনেক দেশের সংস্কৃতিরই অংশ।
ম্যালকম
এক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডের সামাজিক মনোবিজ্ঞানী গার্ট হফস্টিডের ‘কালচারাল ডাইমেনশন থিয়রী’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানী আইবিএম-এর ইউরোপীয়ান ডিভিশনে
কাজ করার সময় ৭০টি দেশের কর্মীদের ওপর জরিপ করেন হফস্টিড। তার গবেষণায় প্রকাশ পায় –
ক্ষমতার প্রভাব, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, পুরুষতান্ত্রিকতা, অনিশ্চয়তা এড়ানো এবং
দীর্ঘকালীন অর্জনের প্রেক্ষাপটে দেশে দেশে মানুষের চিন্তা ভাবনা, যোগাযোগ এবং জীবন
যাপনে যথেষ্ট পার্থক্য ধরা পড়ে। যেমন কোরিয়ার কথা ধরা যাক – সাংস্কৃতিকভাবে এখানে বয়সে এবং পদবীতে উপদস্থদের
যথেষ্ঠ সমীহ করে অধীনস্থরা। কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা
করা কিংবা ভুল ধরিয়ে দেয়ার চর্চা কোরিয়ায় নেই বললেই চলে। ইংরেজিতে একে ‘পাওয়ার
ডিসট্যান্স’ প্রভাব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
হফস্টিডের কালচারাল ডাইমেনশন |
হফস্টিডের
গবেষণার আরেকটি দিক হলো অনিশ্চয়তা এড়ানোর প্রবণতা। এক্ষেত্রেও কোরিয়ানরা উচ্চপদস্থ
ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মেনে নেয়। দূর্ঘটনা কবলিত কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের
ব্ল্যাক বক্স থেকে উদ্ধারকৃত আলাপ আলোচনা থেকে জানা যায়, পাইলটের সহকারীরা খারাপ
আবহাওয়া এবং পাইলটের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছিল বারবার। কিন্তু,
প্রশ্নগুলো ছিল খুব মোলায়েম ভাষায়। বড়কর্তার ভুল ধরিয়ে দেয়ার ভাষা বা ভঙ্গি
কোনোটাই এসব প্রশ্নে ছিল না। ফলে আসন্ন খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া
সম্ভব হয়নি কারো পক্ষে। অথচ, অমন অবস্থায় সহকারীদের পরামর্শ শুনলে পাইলট হয়তো
দূর্ঘটনার হাত থেকে বিমানকে রক্ষা করতে পারতেন। পাইলটের সহকারীরা জোর গলায় কিছু
বলতে পারেনি, কারণ উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ দূরে থাক, আগ বাড়িয়ে
পরামর্শ দিয়ে কারো বিরাগভাজন হওয়াই কোরিয়ান কালচারে দুঃসাহসের কাজ এবং অগ্রহণযোগ্য।
এভিয়ানকার
দূর্ঘটনার পেছনেও রয়েছে কলম্বিয়ার কালচারের প্রভাব। সংস্কৃতিগতভাবে কলম্বিয়ার
মানুষের মাঝে পদমর্যাদার প্রভাবে সৃষ্ট ব্যবধান (পাওয়ার ডিসট্যান্স) ব্যাপক।
অনেকটা কোরিয়ার মতোই, কেউ উচ্চপদস্থের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে না এবং অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে
নিম্নপদস্থরা নির্ভর করে উচ্চপদস্থ ব্যক্তি কী সিদ্ধান্ত নেবেন তার ওপর।
এভিয়ানকা
০৫২ ফ্লাইট প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে প্রায় সোয়া এক ঘন্টা নিউ ইয়র্কের আকাশে চক্কর
খেয়েছে। খুব স্বাভাবিক যে এ সময় বিমানের জ্বালানী কমে আসবে এবং সংকট সৃষ্টি হবে।
ব্ল্যাক বক্সের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে সহকারীরা মূল পাইলটকে এ ইংগিত দিয়েছে
বারবার। পাইলটও তা জেনেছে। তাদের এ
আলাপ তাৎক্ষণিক শুনেছে কেনেডি এয়ারপোর্টের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা।
অথচ কেউই এই জ্বালানী ফুরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলো না!
পরবর্তীতে
দূর্ঘটনা তদন্তকারী দলের কাছে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা
জানায়, তারা ইথারে শুনেছে পাইলট এবং তার সহকারীরা জ্বালানী ফুরিয়ে যাওয়ার কথা আলাপ
করছে। কিন্তু সে আলাপে কোনো তাড়া ছিল না, গুরুত্বের আবহ ছিল না। অথচ অতি-জরুরী
বার্তা পাঠালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ ব্যবস্থায় এভিয়ানকাকে অবতরণের সুযোগ করে
দেয়া যেতো। সেরকম কোনো ইঙ্গিতই পায়নি কেনেডি এয়ারপোর্টের ট্রাফিক কন্ট্রোলার অফিস!
অর্থ্যাৎ
এভিয়ানকা এবং কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের দুটি দূর্ঘটনার পেছনেই ছিল যোগাযোগ এবং
পারস্পরিক সম্পর্কের সাংস্কৃতিক প্রভাব, ককপিট কালচারের প্রভাব।
ককপিট কালচার পরিবর্তন কি সম্ভব?
অবশ্যই
সম্ভব। কোরিয়ান এয়ার ফ্লাইট ৮০১ যখন দূর্ঘটনায় পড়ে তখন নিরাপত্তার দিক থেকে
কোরিয়ান এয়ারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সারা বিশ্বে সবচেয়ে জঘন্য। বেশ কিছু
গুরুত্বপূর্ণ এয়ারপোর্ট কোরিয়ান এয়ারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিল। ২০০০ সালে
কোরিয়ান এয়ার কর্তৃপক্ষ ডেভিড গ্রীনবার্গ নামের এক কর্মকর্তাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে
নিয়োগ দেয়। গ্রীণবার্গ আগে ডেলটা এয়ার লাইন্সে কাজ করতেন।
গ্রীণবার্গ
প্রথমেই যে পরিবর্তনটি আনেন তা হলো ভাষার ব্যবহার। কোরিয়ান এয়ারে ইংরেজী ভাষার
ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করা হয়। পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার এবং কেবিন ক্রুদের জন্য ইংরেজী
ভাষার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। এ পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিতে না পারলে
কর্মীদের কোরিয়ান এয়ার ছেড়ে অন্যত্র চাকরী খোঁজার নির্দেশও দেয়া হলো।
গ্রীণবার্গ
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত নিলেন তা হচ্ছে, ফ্লাইট পরিচালনার সময়
আন্তর্জাতিক মানের কোড এবং বাক্য ব্যবহার করা। ভাষাতত্ত্ব বিশ্লেষণে দেখা গেছে –
কোরিয়ান ভাষা অনেক বেশি পরোক্ষ এবং বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ অনেক ক্ষেত্রে
শ্রোতার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। এয়ারলাইন্সে আধিপত্যসুলভ ব্যবস্থার কারণে
অধীনস্থের মুখে কোরিয়ান ভাষা আরো মোলায়েম হয়ে ওঠে। ফলে সংকটের মুহূর্তে জরুরী
কথাগুলো আর জোর গলায় বলা হয় না।
গ্রীণবার্গের
মতে, কোরিয়ান ভাষার তুলনায় ইংরেজী ভাষা অনেক বেশি সরাসরি এবং পরিস্কার ভাব প্রকাশ করে। তাই
ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করলে পারস্পরিক যোগাযোগে মোলায়েম কিংবা মিনমিনে ভাব কেটে গিয়ে
প্রকৃত বার্তাটাই জোরালো হয়ে উঠবে।
গ্রীণবার্গের
ধারণাই সঠিক ছিল। ২০০৬ সালে এসে কোরিয়ান এয়ারের নিরাপত্তা রেকর্ড প্রায় নিখুঁত হয়ে
উঠলো। এমন পরিবর্তনের স্বীকৃতি হিসেবে সে বছর কোরিয়ান এয়ারকে সম্মানসূচক ফনিক্স
অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিল এয়ার ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্ল্ড নামের একটি সংস্থা। বিশ্বের আরো
বেশ কিছু এয়ারলাইন্স ককপিট কালচার উন্নয়নের দিকে মন দিয়েছিল বিভিন্ন সময়।
আবারও আলোচনায় ককপিট কালচার
২০১৩
সালের ৬ জুলাই কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এয়ারলাইন্স কোম্পানি আসিয়ানার ফ্লাইট নম্বর
২১৪ স্যান ফ্রানসিস্কো বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হলে আবারও ককপিট কালচারের প্রসঙ্গ
আলোচনায় আসে। আসিয়ানার ৩০৭ জন আরোহীর মাঝে মাত্র ৩ জন মারা গেলেও বোয়িং৭৭৭
ক্রাফটের দশ বছরের ইতিহাসে প্রথম দূর্ঘটনা হিসেবে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
বিধ্বস্ত আসিয়ানা ২১৪ |
তদন্ত
প্রতিবেদনে দূর্ঘটনার কারণ হিসাবে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি এমন তথ্যও উঠে আসে যে
ব্ল্যাক বক্সের রেকর্ডে শোনা গেছে দূর্ঘটনার আগে অন্ততঃ একাধিকবার পাইলটকে তার
সহকারীরা অনুরোধ করেছিল অবতরণ বাতিল করতে। কিন্তু পাইলট তাদের কথায় কান দেয়নি।
কোরিয়ার কর্তৃত্বসূলভ সামাজিক ব্যবস্থার কারণে এমন হয়েছে বলেই অনেকে মনে
করেন।
ওয়াল
স্ট্রীট জার্নাল তাদের এক প্রতিবেদনে ককপিট কালচারের কথা উল্লেখ করে জানায় –
শাস্তির ভয়ে এশিয়ার বিমানগুলোয় সহকারীরা তাদের প্রধান পাইলটকে অনেক কথা বলে না। প্রতিবেদনটি এক্ষেত্রে এশিয়ার
আরো দুটি বিমান দূর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে, যেখানে সাংস্কৃতিক প্রভাবে এবং
কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণে প্রধান পাইলট তার সহকারীদের মতামতকে পাত্তা দেয়নি এবং শেষে
দূর্ঘটনায় পড়েছে।
প্রথমটি
থাইল্যান্ডের ওয়ান-টু-গো এয়ারলাইন্স। ফুকেট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ঝড়ো
আবহাওয়ায় অনেক দ্রুত গতিতে এবং প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাড়াভাবে অবতরণ করতে গিয়ে
২০০৭ সালে বিমানটি দূর্ঘটনায় পড়ে। তদন্তে প্রকাশিত হয়, সহকর্মীরা পাইলটকে এ
ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছিল, কিন্তু পাইলট তার অধীনস্থদের কথায় বিন্দুমাত্রও
গুরুত্ব দেয়নি।
অন্যটি
এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের ফ্লাইট ৮১২। দুবাই থেকে কর্ণাটক রাজ্যের ম্যাঙ্গালোরে
যাওয়ার পথে ২০১০ সালের ২২ মে ম্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টের রানওয়ের বাইরে বিধ্বস্ত হয়
বিমানটি। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সহকারীদের দেয়া সতর্কতামূলক বার্তাগুলো
প্রধান পাইলট কানে নেয়নি। নিষেধ করা সত্ত্বেও পাইলট অবতরণের চেষ্টা চালায় এবং
বিধ্বস্ত হয়। ভয়াবহ এ দূর্ঘটনায় ১৬৬ জন আরোহীর ১৫৮ জনই মারা যায়। উল্লেখ্য,
বিমানটির একমাত্র বাংলাদেশী যাত্রী, সাবরিনা নাসরিন হক, প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
ককপিট কালচারের বিরোধিতা
ককপিট
কালচার ধারণাটির সমালোচকেরও কমতি নেই। অনেকে মনে করেন, এটি ত্রুটিপূর্ণ এবং
ভ্রান্ত একটি ধারণা। বিশেষ করে, ২০১৩ সালের ৬ জুলাই আসিয়ানা এয়ারলাইন্স বিধ্বস্ত
হলে আবার যখন বিভিন্ন মিডিয়ায় ককপিট কালচার আলোচনায় আসে, তখন ১১ জুলাই একজন
কোরিয়ান ব্লগার তার ওয়েবসাইটে তীব্র ভাষায় ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের লেখার বিভিন্ন
দূর্বল দিক উল্লেখ করে কঠোর সমালোচনা করেন। দেড়শ’রও বেশি পাঠক এ লেখার
প্রতিক্রিয়া জানায় মন্তব্যের ঘরে। তথ্য উপাত্ত এবং অনুমানভিত্তিক বিভিন্ন মন্তব্যে
উঠে আসে ককপিট কালচারের পক্ষ-বিপক্ষের নানা দিক।
কোরিয়ান
ব্লগারের লেখার প্রতিক্রিয়া
জানান ম্যালকম ঠিক চার দিনের মাথায়। লেখাটি অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে, তাই সে
সব বিস্তারিত আর এখানে লিখছি না। আগ্রহী পাঠক চাইলে অনলাইনে বিস্তারিত পড়ে
নিতে পারেন। নিরাশ হবেন না আশা করি।
মালয়েশিয়ান এয়ার ৩৭০
২০১৪
সালের ৮ মার্চে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট৩৭০ উধাও হয়ে গিয়েছিল। নানান অনুসন্ধান শেষে ধারণা করা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরের কোনো
এক অংশে বিধ্বস্ত হয়েছে এটি। প্রশ্ন জাগে, মালয়েশিয়ান এয়ারও কি তবে ককপিট কালচার সমস্যার শিকার? ব্ল্যাক বক্স খুঁজে
না পাওয়া পর্যন্ত সে প্রশ্নের উত্তর এখনো দেয়া যাবে না।
তবে
উৎসুক পাঠককে একটি তথ্য জানিয়ে রাখি – কোরিয়ান
এয়ার এবং এভিকানার ককপিট কালচার বিশ্লেষণ করা হয়েছিল যে হফস্টিড মডেলের ওপর ভিত্তি
করে তার ‘পাওয়ার ডিসট্যান্স’ ইনডেক্সের প্রথম স্থানটি দখল করে আছে মালয়েশিয়া।
তাই, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সামগ্রিক ককপিট কালচার কেমন তা অবশ্যই অনুসন্ধিৎসু
মনের দরজায় টোকা দিয়ে যাবে বারবার।
ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল কী বলেন?
মালয়েশিয়ান
এয়ার ৩৭০ হারিয়ে যাওয়ার পরে ম্যালকমের কাছে ইমেইলে জিজ্ঞেস করেছিলাম -
এখানেও ককপিট কালচারের ভূমিকা আছে কিনা। ফিরতে মেইলে ম্যালকম আমাকে লিখেন -
"thanks for your note. yes! i did think about that with respect to
malaysian air. it is very difficult to draw a conclusion, however, until
we have a more complete explanation for the accident. the pilots might
have been blameless."
***
নোটঃ
মূল
লেখাটি ২০১৪ সালের নভেম্বরে "রহস্যপত্রিকা"য় ছাপা হয়েছিল। কিছু পরিসংখ্যান
আপডেট করে, কিছু লিংক সংযুক্ত করে এ লেখা প্রকাশ করা হলো।
No comments:
Post a Comment