টর্চেস অব ফ্রিডম

ধুমপান বিরোধী প্রচারণা নাকি শেষ পর্যন্ত ধুমপানের বিজ্ঞাপন হয়ে যায়। দেখা গেছে, অ্যান্টি স্মোকিং ক্যাম্পেইন যতো বাড়ে, সিগারেটের বিক্রিও ততো বেশি হয়।
এ যেন পাগলকে সাঁকো না নাড়াতে বলার – গল্পের মতো।

*

১ম বিশ্বযুদ্ধের পরে, বিশেষ করে যখন সৈনিকদের রেশন তালিকায় সিগারেটও যোগ হলো, আমেরিকায় সিগারেটের ব্যাপক প্রসার ঘটে। প্রথাগতভাবে সিগারেট ছিল পুরুষত্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক।
১ম বিশ্বযুদ্ধে পুরুষরা যখন রণাঙ্গণে, আমেরিকার নারীরা ঘরের বাইরে এসে নানান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়। সে সময় নারী-পুরুষের সমতার দাবীর পাশাপাশি নারীদের ভোটের এবং ধুমপানের অধিকারও আলোচনায় আসে।

*

আমেরিকান সমাজে নারীদের ধুমপান তখনো অগ্রহণযোগ্য। সামাজিক রীতিতে মনে করা হতো কেবল চরিত্রহীন নারীরাই ধুমপান করে। নাটক সিনেমায়ও কেবল দুষ্ট ও দুশ্চরিত্র নারীকে ধুমপান করতে দেখা যেতো। সে সময় উঁচু তলার প্রভাবশালী কিছু নারী প্রকাশ্যে ধুমপানের চেষ্টা করলেও চর্চাটি সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি।

*

জর্জ ওয়াশিংটন হিল নামের ভদ্রলোক, যিনি ১৯২৮ সালে অ্যামেরিকান টোবাকো কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট ছিলেন, বেশ ভাবনায় পড়লেন নারীদের ধুমপানের বিষয়টি কীভাবে সামাজিক স্বীকৃতির পর্যায়ে আনা যায়। কেবল পুরুষদের কাছে সিগারেট বিক্রি করে তার পোষাচ্ছিল না।
জর্জ নারীবাদী না, সুবিধাবাদী ছিলেন। জর্জ এ নিয়ে দারস্থ হলেন এডওয়ার্ড বার্নি নামের এক পরামর্শকের। 

*

প্রস্তাব ছিল এরকম – লাকী স্ট্রাইক ব্র্যান্ডের সিগারেট নারীদের কাছে বিক্রি করার স্ট্র্যাটেজি বানাতে হবে। সালামী হিসাবে বার্নি পাবেন ২৫ হাজার ডলার। সে-ই ১৯২৮-২৯ সালে ২৫ হাজার ডলার কিন্তু বিশাল...

*


৩১ মার্চ, ১৯২৯। বার্নি তার ম্যাজিক দেখান।
সেদিন ইস্টার প্যারেডের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বার্থা হান্ট নামে এক নারী প্রকাশ্যে সিগারেট ধরান। মুহূর্তেই নারীদের ধুমপানের অধিকারের দাবী সম্বলিত লিফলেট চারপাশ থেকে মানুষের মাঝে ছুড়ে দেয়া হয়। অনেক সাংবাদিকের ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক করে ওঠে। উপস্থিত সাংবাদিকদের বার্থা জানান – নীরব থাকার দিন ফুরিয়ে গেছে, সিগারেট কেবল পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও; এই ধারণাটি প্রকাশ করতেই বার্থা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন।

*

পরদিন, ১লা এপ্রিল, পত্রিকায় ব্যাপক গুরুত্বের সংগে ছবিসহ এ সংবাদ পরিবেশিত হয়। লেখা হলো, নারীদের সিগারেটে আগুন ধরানো মূলতঃ তাদের স্বাধীনতার মশাল (টর্চেস অব ফ্রিডম); ধুমপান নারী স্বাধীনতার এবং শক্তি প্রকাশের প্রতীক। বার্থার এই সাহসী পদক্ষেপ আমেরিকান নারীদের সিগারেট বিষয়ে নতুন করে ভাবাবে...।

*

প্রকাশিত সংবাদের আড়ালের যে সত্য সেদিন কেউ জানেনি তা হলো – ইস্টার প্যারেডে এমন কিছু ঘটবে সেটা জানিয়ে সাংবাদিকদের আগেই জড়ো করা হয়েছিল। ঐসব লিফলেট বিতরণের জনবলও প্রস্তুত ছিল। আর বার্থা হান্ট নামের নারীটি ছিল এডওয়ার্ড বার্নির অফিস সেক্রেটারী!
১লা এপ্রিলের সংবাদপত্রে বার্থা-কাহিনী পড়তে পড়তে বার্নি কি একবারের জন্যও মনে মনে কাউকে ‘এপ্রিল ফুল’ বলেছিলেন?
এই ‘টর্চেস অব ফ্রিডম’ ক্যাম্পেইনই ছিল বার্নির ম্যাজিক।

*

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। পরদিন আরও দশ নারী প্রকাশ্যে ধুমপান করে বার্থার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ধুমপানের অধিকার নারী স্বাধীনতার প্রতীক; এই ধারণায় প্রভাবিত হলো বা এগিয়ে এলো আরো অনেক নারী।
হু হু করে লাকী স্ট্রাইক ব্র্যান্ডের বিক্রি বাড়তে থাকে; প্রায় দ্বিগুণ! এটাই আমেরিকায় নারীদের ধুমপানের টিপিং পয়েন্ট।

*

২৫ হাজার ডলারের সালামী তখন নগণ্য হয়ে যায়। লাকী স্ট্রাইক ব্র্যান্ডের পরামর্শক হিসাবে আরো ৮ বছর কাজ করেন বার্নি। ততদিনে নারীরা সিগারেট কোম্পানীগুলোর প্রকাশ্য টার্গেট মার্কেট হয়েছে – ভোটের অধিকার না পেলেও নারীরা প্রকাশ্যে ধুমপানের অধিকার পেয়েছে।

*

অনেক পরে বার্নি স্বীকার করেন - ‘টর্চেস অব ফ্রিডম’ ক্যাম্পেইনে হয়তো কিছুটা প্রোপাগান্ডা ও চাতুর্য্য ছিল, তবে বিজ্ঞাপন এবং পাবলিক রিলেশনের ইতিহাসে এই ক্যাম্পেইন এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।

***

ফুটনোটঃ
বার্নি নামের লোকটা বেশ কামেল টাইপ। তাত্ত্বিক বই লেখার পাশাপাশি ব্যবসায়িক পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছেন অনেক। আরেক ওস্তাদী লোক সিগমন্ড ফ্রয়েড ছিলেন বার্নির মামা। ১৯৯৫ সালে, মৃত্যুর পরে, বার্নিকে ‘ফাদার অব পাবলিক রিলেশন’ ঘোষণা করা হয়।

***
কপি-পেস্ট নিষিদ্ধ