ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স: ভুল সবই ভুল

যাত্রীরা প্লেনে উঠে বসার পরেও প্লেন ছাড়ছে না। পাইলট বারবার ঘোষণা দিচ্ছে – প্লেন ফুয়েল নিচ্ছে। দু’ঘন্টা এভাবে বসে থাকার পরে গরমে, অক্সিজেনের অভাবে, এক শিশু ভয়ানক অসুস্থ হয়ে গেল। তাকে নেয়া হলো হাসপাতালে।
আরেক শিশু সারা পথ বাবা মায়ের কোলে বসে গেল, কারণ তার টিকিট দু’বার বিক্রি করা হয়েছে!
ক্যানসাসগামী কুকুর চলে গেল জাপানে!
আরেক কুকুরছানা প্লেনেই মারা গেল কেবিন ক্রুর ভুলে।

এ সবই ঘটছে আমেরিকার ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে

কিন্তু, কেন হচ্ছে এরকম?

প্রথমে পুরনো গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।
গল্প হলেও সত্যি – অনেকেই জানেন; তবুও ফিরে দেখি ২০০৮-২০০৯। এক প্যাসেঞ্জারের গিটার ভেঙ্গে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ক্ষতি হয়েছিল ১৮০ মিলিয়ন ডলার।

কী ঘটেছিল?
৩১ মার্চ ২০০৮।
ডেভ ক্যারল; মিউজিক ব্যান্ড আছে তার। কানাডার হেলিফ্যাক্স থেকে গানের দল নিয়ে যাচ্ছে আমেরিকার নেব্রাস্কায়। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে পথে ট্রানজিট শিকাগো’র ও’হেয়ার এয়ারপোর্টে। এতটুকু পথ ঠিক ছিল। শিকাগো থেকে নেব্রাস্কাগামী প্লেনে উঠে বসলো ডেভ ও তার সঙ্গী-সাথীরা। নিচে তখনো মালামাল আপলোড চলছে।

হঠাৎ ডেভের পেছনে বসা এক প্যাসেঞ্জার বলে উঠলো, “হায় খোদা! এভাবে গিটার ছুড়ে মারে?”
ডেভের বুক ধুক করে উঠলো। জিজ্ঞাসায় জানতে পারলো, গ্রাউন্ড স্টাফ যারা প্লেনে মাল আপলোড করছে, ওদের একজন কেয়ারলেসভাবে গিটার ছুড়ে মেরেছে।
শুনে ডেভের কলিজার পানি শুকিয়ে গেল; খুব সম্ভবতঃ ওটা তারই গিটার...
সঙ্গে সঙ্গে সে কেবিন ক্রুদের ডেকে এই গিটার ছোড়ার কথা জানালো, সাথে শংকাও প্রকাশ করে রাখলো – ওটা তার গিটার।
কেবিন ক্রু সাহস দিলো – যদি ভাঙ্গে তবে পরে দেখা যাবে। আপাততঃ নিরাপদে গন্তব্যে (নেব্রাস্কা) যাওয়া যাক!

নেব্রাস্কা এয়ারপোর্টে গিটার যখন হাতে এলো তখন দেখা গেল ডেভের আশংকাই ঠিক; তার সাধের টেইলর গিটার ভেঙ্গে গেছে!

আবার অভিযোগের পালা।
নির্ধারিত ফরম ফিল-আপ করে ভাঙ্গা মন আর ভাঙ্গা গিটার হাতে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো ডেভ। আমেরিকার কয়েক শহরে কনসার্ট করার কথা। আপাততঃ সেদিকে মন দেয়া যাক।

আমেরিকা ভ্রমণ শেষ হলো। কিন্তু গিটার ভাঙ্গার অভিযোগ নিয়ে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স থেকে কোনো আপডেট এলো না। ডেভ ফোন করলো নাব্রাস্কার ইউনাইটেড এয়ার অফিসে। ওরা জানালো, “গিটার আমাদের এয়ারপোর্টে ভাঙ্গে নাই, তাই আমরা কোনো দায়িত্ব নেবো না। তুমি শিকাগো এয়ারপোর্টে কমপ্লেইন করো।”

কী আর করা?

ডেভ এবার শিকাগো এয়ারপোর্টে অভিযোগ জানালো। কিছুদিন পরে ওখান থেকে জবাব এলো, “আমাদের রেকর্ড দেখাচ্ছে, তুমি এখানে এক নিছক ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার। এর বাইরে অন্য কোনো বিত্তান্ত নেই। অভিযোগ যদি করতেই হয়, তুমি যেখান থেকে প্লেনে উঠেছো (হ্যালিফেক্স) অথবা যেখানে শেষ নেমেছো (নেব্রাস্কা) সেখানে করো”।

হায় ঈশ্বর!

ডেভ ততদিনে কানাডায় ফিরে গেছে। তাই ভাবলো – নিজের শহরে তবে অভিযোগ করা যাক। কিন্তু খবর নিয়ে সে জানলো হ্যালিফেক্সে ইউনাইটেড এয়ারের কোনো অফিসে নেই। কারণ, কানাডায় ইউনাইটেড যৌথভাবে এয়ার কানাডার সঙ্গে ফ্লাইট অপারেট করে।

এটা জানার পরে ডেভ আবার নেব্রাস্কায় মেইল করলো। কোনো জবাব আসে না। ফোন করলো বারবার। ওপাশ থেকে দেখছি-দেখবো জানাচ্ছি-জানাবো চলছিল। আরও কয়েকবার তাড়া দেয়ার পরে ওরা জানালো – ডেভের জমা দেয়া সব অভিযোগপত্র হারিয়ে গেছে, সুতরাং আরেকবার অভিযোগ দাখিল করতে হবে।
ডেভ সেটাই করলো।

কিন্তু কোনো খবর নেই। আবার তাগাদা চললো। ফোনে, ইমেইলে দুই ধরণের জবাব পাওয়া গেল – ১) গিটার যে ইউনাইটেডের অবহেলায় ভেঙ্গেছে তার সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তাই ইউনাইটেড কোনোরকম ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য না। ২) ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। তাই অভিযোগ আমলে নেয়া সম্ভব না।

এরকম অদ্ভুত জবাব পেয়ে ডেভ আবার মেইল করলো। শিকাগো-নেব্রাস্কা-হ্যালিফেক্স এই চক্করে কী কী ঘটেছিল – সব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ শুনতে রাজী না। তাদের এক কথা – এই অভিযোগ ইউনাইটেড নীতিমালা ও সাধ্যের বাইরে...

হতাশ না হয়ে ডেভ প্রস্তাব দিলো – “ঠিক আছে, আমার গিটারের দাম সাড়ে তিন হাজার ডলার। ভাঙ্গা গিটার ঠিক করতে বারোশ’ ডলার লাগবে। ঐ বারোশ’ ডলার দিলেই হবে। ক্যাশ দেয়া লাগবে না। এয়ার টিকিটের ভাউচার দিলেই হবে...”

ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ তাতেও রাজী না; এবার “ফাইনাল নো” বলে ডেভকে শেষ ইমেইল করলো – “আগামীতে এ সংক্রান্ত আর কোনো অভিযোগ অনুযোগের ইমেইল রিপ্লাই ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ দেবে না”।

ফোনে রাগে-ক্ষোভে-হতাশায়-কিংকর্তব্যবিমুঢ় ডেভ ফোনে বললো, “ওকে, ফাইন! কী আর করা! আমি গায়ক মানুষ, তোমাদের নিয়ে আমি তিনটা গান গাইবো”। (পরে এক সাক্ষাৎকারে ডেভ বলেছে সে নিজেই জানতো না কেন সে তিনটা গানের কথা বলেছে। গান গাওয়ার আইডিয়াও ঐ মুহূর্তে কীভাবে মাথায় এলো ডেভ মনে করতে পারে না)।

তবে হঠাৎ করে বলে ফেলা কথাটাই সত্যি হলো।
মাসের পর মাস গিটার ভাঙ্গার ক্ষতিপূরণ চাইতে চাইতে সময়-শ্রম নষ্ট করে, ডেভ এবার সত্যি সত্যি ইউনাইটেড এয়ার নিয়ে গান বেঁধে ফেললো। হ্যালিফেক্স থেকে নেব্রাস্কা যাওয়ার পরে কীভাবে গিটার ভাঙলো এবং এ সংক্রান্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা উঠে আসে গানের কথায়। কিছু সুহৃদ বন্ধুর সহায়তায় মিউজিক ভিডিও বানানো হলো।

২০০৯ সালের ৬ জুলাই রাতে ৪ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের “ইউনাইটেড ব্রেকস গিটারস” ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোড করলো ডেভ। সুপ্ত আশা ছিল, ৬ মাসে এক মিলিয়ন ভিউ পাবে। কিন্তু, প্রথম দিনেই ভিউ এলো ১ লাখ ৫০ হাজার। জুলাই মাসের শেষে গিয়ে ভিউ সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। আর আগস্টের মাঝামাঝিতে ভিউ ৫ মিলিয়নে পৌঁছালো।


 

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯’র ঐ সময়টায় সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। বিশেষ করে, ফেসবুক-টুইটারে হাল আমলের ঘটনাগুলো ভাইরাল হচ্ছে। সেই জোয়ারে ডেভ ক্যারলের গান “ইউনাইটেড ব্রেকস গিটারস” ব্যাপক হিট হলো। ইউটিউবের কমেন্ট সেকশনে আরো অনেক অনেক ভুক্তভোগী জড়ো হলো – ইউনাইটেড কারো ব্যাগ ভেঙ্গেছে, ব্যাগ হারিয়ে গেছে, কারো টিকিট বাতিল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে কমেন্ট বক্স হয়ে উঠলো কমপ্লেইন বক্স!

ব্যাপারটি সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি মূলধারার সংবাদ মাধ্যমেরও নজর কাড়লো। টিভি-রেডিওতে বেশ কিছু লাইভ ইন্টারভিউ দিলো ডেভ। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে এই গিটারকান্ড প্রকাশিত হলো।

ইউটিউবে ভিডিও প্রকাশের চার সপ্তার মধ্যে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের শেয়ারের দাম ১০% পড়ে গেল; যার মোট মূল্যমান প্রায় ১৮০ মিলিয়ন ডলার।


১৭ আগস্ট ২০০৯।
ইউনাইটেড ব্রেকস গিটারস – ২ রিলিজড হলো ইউটিউবে।
ততদিনে টনক নড়েছে ইউনাইটেডের। তারা ফোন করে ডেভের কাছে ক্ষমা চাইলো, ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলো। কিন্তু ডেভের জগত তখন পালটে গেছে; বিখ্যাত হয়ে গেছে সে। আগের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে করে ডেভ এই ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলো। সঙ্গে বিদ্রুপ করে বললো – ইউনাইটেড চাইলে ঐ অর্থ কোনো চ্যারিটিতে দান-খয়রাত করতে পারে। ইউনাইটেড সত্যি সত্যি ১২০০ ডলার চ্যারিটিতে দান করেছিল; কিন্তু হয়ে যাওয়া ক্ষতি সামাল দিতে পারেনি।

ইন্টারনেটে ডেভ ক্যারলের গান এতোই জনপ্রিয় হলো যে ২০০৯ সালের টপ টেন ভাইরাল ভিডিওর তালিকায় ৭ নম্বরে ছিল – ইউনাইটেড ব্রেকস গিটারস। পরের বছর, ২০১০ সালে, মার্চে ডেভের তিন নম্বর গানটি প্রকাশিত হয় ইউটিউবে। ডেভ ততদিনে অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে উঠেছে। ভোক্তার অধিকার রক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছে। এমনকী কাস্টমার রিলেশনশীপ ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত বড় বড় কনফারেন্সে এবং ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমেও ডেভ গেস্ট স্পীকার হিসাবে হাজির হলো

অ্যাকাডেমিক রিসার্চে এই গিটারকান্ড বেশ সাড়া জাগিয়েছে। মার্কেটিং, পাবলিক রিলেশন, কাস্টমার রিলেশনশীপ এবং সার্ভিস ফেইলিওর বিভাগে অনেকগুলো গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে।



জার্নাল অব মার্কেটিং-এ প্রকাশিত লেখা।




জার্নাল অব সার্ভিস থিয়রি অ্যান্ড প্র্যাক্টিসে প্রকাশিত লেখা


হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে কেইস স্টাডিজ প্রকাশিত হয়েছে। এরকম প্রতিশোধমূলক আচরণকে কাস্টমার সাবোটাজ বলেও আখ্যায়িত করা হলো।


হার্ভার্ড থেকে প্রকাশিত কেইস স্টাডি



২০১২ সালের মে মাসে সামগ্রিক অভিজ্ঞতা নিয়ে ডেভ ক্যারলের লেখা বই “United Breaks Guitars: The Power of One Voice in the Age of Social Media” প্রকাশিত হয়।


ডেভ ক্যারলের লেখা বই


বুদ্ধিমান টেইলর গিটারস কোম্পানী!
ডেভ ক্যারলের সঙ্গে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের এই কান্ড যখন সোশ্যাল মিডিয়ার নেটিজেনরা পপকর্ন হাতে দেখছে, তখন দৃশ্যপটে হাজির হয় টেইলর গিটারস কোম্পানী। ডেভের গানে বারবার টেইলর ব্র্যান্ডের নাম এসেছে। ফলে, একরম অনাকাঙ্ক্ষিত কাভারেজ পেয়েছে তারা। ডেভ বনাম ইউনাইটেডের আগুনের উত্তাপে টেইলর কোম্পানী আলু পুড়িয়ে নিয়েছে। তারা প্রথমেই ডেভ ক্যারলকে একেবারে নতুন একটি টেইলর গিটার উপহার দিয়েছে – ফ্রি!


পাশাপাশি তাদের ইউটিউব চ্যানেলে ১ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও আপলোড করে ডেভের তিক্ত অভিজ্ঞতায় সমব্যথী হয়েছে। সেই ভিডিওতে তারা সব গিটার মালিকদের এটাও মনে করিয়ে দিয়েছে যে গিটার ভাঙলে মন ভেঙ্গে যায়। তবে যে কোনো রকম ভাঙ্গা গিটার টেইলর কোম্পানী মেরামত করতে পারবে। কারো গিটার ভাঙ্গলে তারা যেনো নির্দ্বিধায় টেইলর কোম্পানীর সেবা নেয়। এখানেই শেষ নয়; নিজেদের ওয়েবসাইটে তারা গিটারের যত্ন বিষয়ক কিছু ফ্রি হেল্প টিপসও আপলোড করেছে। বিশেষ পরামর্শ দিলো, ট্রাভেলের সময় গিটার কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়!

এভাবেই টেইলর গিটার এক রকম অপ্রত্যাশিত এবং লাভজনক প্রচার প্রসার পেয়ে গেল সে সময়!


ইউনাইটেডের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
ইউনাইটেড চুপ ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছে ইউনাইটেড। শুরুর দিকে ডেভ ক্যারলের গানকে বিচ্ছিন্ন-ঘটনা (ঝুড়ির পঁচা আপেল) বলে এড়াতে চাইলেও ব্যাড পাবলিসিটির ঝড়ো হাওয়া ইউনাইটেডের কর্পোরেট ইমেজকে প্রায় নগ্ন করে ফেলেছে; এতোই অস্বস্তিকর। বারোশ’ ডলার চ্যারিটিতে দিয়েও লাভ হলো না। এবার ইউনাইটেড আরেক পথ ধরলো।
নিজেদের কাস্টমার ট্রেনিং প্রোগ্রাম নতুনভাবে সাজালো। সেই ট্রেনিং-এর শুরুতেই ডেভ ক্যারলের ইউনাইটেড ব্রেকস গিটারস গান দেখানো হয়। কর্মীদের এই বার্তা সুস্পষ্টভাবে দেয়া হলো যে স্রেফ একটা ভুলের কারণে কোম্পানীর ১৮০ মিলিয়ন ডলার খরচ গচ্ছা গেছে, সুনাম নষ্ট হয়েছে। অভিযোগ আমলে নিয়ে শুরুতেই সমস্যা সমাধান করলে এই ১৮০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ৫২ হাজার নতুন টেইলর গিটার কেনা যেতো!
তাই এখন উদ্দেশ্য একটাই – এরকম ভুল যেন আর না ঘটে।

কিন্তু, ঘটনার ঘনঘটা ইউনাইটের ক্যালেন্ডারে পাতায় পাতায় লেখা।
গিটার কান্ডের পরে ইউনাইটেড ক্রমাগত খারাপ কাস্টমার সার্ভিসের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে টিকিট থাকা সত্ত্বেও এক শিশুকে বাবা-মায়ের কোলে বসে চার ঘন্টার জার্নি করতে হয়েছে। ঐ শিশুর নামে কেনা টিকিট আরেক যাত্রীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল ইউনাইটেড! যদিও টিকিটের দাম রিফান্ড করে ক্ষমা চেয়েছে ইউনাইটেড, সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে দুনিয়ার কাছে এই খবর পোঁছে গেছে খুব দ্রুত।

২০১৮ সালের মার্চে এক যাত্রীর ১০ মাসের কুকুর ছানা মারা গেছে ইউনাইটেডে ফ্লাইটে। পোষা প্রাণীর জন্য নির্ধারিত খাঁচায় যথাযথভাবে বহন করলেও, কেবিন ক্রু একরকম জোর করে কুকুর ছানার খাঁচাটিকে ওভারহেড কম্পার্টমেন্টে তুলে রাখে। সেখানেই, সম্ভবতঃ অক্সিজেনের অভাবে, মারা যায় ছানাটি।

আরেকটি ১০ বছরের কুকুর ইউনাইটেডের কার্গো প্লেনে আমেরিকার ওরিগন থেকে ক্যানসাসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, ভুল ম্যানেজমেন্টে ঐ কুকুর চলে গেছে জাপানে!

২০১৭ সালের জুনে একবার সব প্যাসেঞ্জার সীটে বসার পরে ফ্লাইট ডিলে হয় প্রায় দুই ঘন্টা। পাইলট বারবার ঘোষণা দিচ্ছে – প্লেন ফুয়েল নিচ্ছে। দু’ঘন্টা এভাবে বসে থাকার পরে গরমে, অক্সিজেনের অভাবে, এক শিশু ভয়ানক অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে নেয়া হলো হাসপাতালে। ইউনাইটেডের ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আবারও সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল।

২০১৫ সালে ৭১ বছর বয়েসী এক যাত্রীকে ধাক্কা মেরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিল ইউনাইটেডের এক কর্মী। তদন্ত শেষে ঐ কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।

২০১৭ সালে লেগিংস পরার কারনে দুই নারী যাত্রীকে প্লেনেতুলতে অসম্মতি জানায় ইউনাইটেড। এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আরেক দফা তোলপাড় হয়েছিল। যদিও পরে এক বিবৃতিতে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে – ঐ দুই নারী ইউনাইটেডের ‘স্টাফ-পাস’ ব্যবহার করছিল, যার অন্যতম শর্ত ছিল বিশেষ ড্রেসকোড মেনে প্লেনে চড়তে হবে।

এরকম আরো অর্ধশত ঝামেলা পাঁকিয়েছে ইউনাইটেড এয়ার।
তবে এই আধা ডজন ঘটনাকে ছাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিলে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এক যাত্রীকে টেনে হিঁচড়ে প্লেন থেকে নামিয়ে তীব্র সমালোচনা ও তোপের মুখে পড়েছিল। 


 
এয়ারলাইন্স ইন্ডাস্ট্রিতে ওভারবুকিং খুব অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না। কিন্তু, ঐ যাত্রীকে অনেকটা পশুর মতো টেনে অমানবিকভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় প্লেন থেকে বের করে নেয়ার ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে বিশ্ববাসী জেনে গেছে। সবচে’ বড় সমস্যা – ইউনাইটেড ক্ষমা না চেয়ে উলটো ঐ যাত্রীকে অভদ্র আচরণের জন্য দায়ী করেছে। প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ইন্টারনেটে তুমুল সমালোচনার ঝড় ওঠে। পাশাপাশি ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় ভুক্তভোগী যাত্রী। পরে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান হয়। তবে মিডিয়ার তীব্র নিন্দা এবং বিদ্রুপে ইউনাইটেডের ব্র্যান্ড ইমেজে লাগা কাদা কতোটা পরিস্কার হয়েছে – সে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

আগ্রহী পাঠক Fly the friendly skies meme লিখে গুগলে ইমেজ সার্চ দিলেই দেখবেন মানুষের বিদ্রুপ এবং ঠাট্টার এক ঝলক।


ইন্টারনেট মিম

সমস্যা কোথায়?
এতো এতো অভিযোগ নিয়েও আমেরিকার এই বিমান সংস্থা কীভাবে টিকে আছে? হয়তো ডিমান্ড-সাপ্লাই মিলছে বলছে প্লেন আকাশে ডানা মেলছে; রেভিনিউ লাইন গতিশীল থাকছে। কিন্তু, কাস্টমার কেয়ারের এই বেহাল দশা কেন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন –
প্রধান সমস্যা হলো – অদক্ষ ও অবেবিচক কর্মী বাহিনী। অস্বীকার করার উপায় নেই ইউনাইটেডে যথেষ্ট ‘বাধ্যতামূলক’ ট্রেনিং প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু সেই ট্রেনিং-এর ফলাফল কোথায়? একের পর এক অঘটন তো ঘটেই যাচ্ছে!

যাত্রীরা কেমন সেবা চায় আর কর্মীরা কী দিতে পারে; এই দুইয়ের যথাযথ সম্মিলন ঘটছে না। গৎবাধা নিয়ম কানুনের বাইরে গিয়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে যাত্রীর প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার প্রয়োগে ইউনাইটেডের কর্মীরা ব্যর্থ।

প্রশ্ন আছে কর্পোরেট লিডারশীপ নিয়েও। বিশেষ করে ২০১০ সালে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ও কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের দূর্বল মার্জারের পরে অর্গানাইজেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট দেখা গেছে। কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে; এসব বিষয় নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে, কাস্টমার সার্ভিসে দ্বিধা এবং বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে বারবার, ভুল হচ্ছে – অঘটন ঘটছে। নিয়ম নীতিতে যেসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। এমনও অভিযোগ আছে – প্রয়োজনের চেয়ে কম কর্মী দিয়ে চলছে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স। এর পেছনে কোম্পানীর মুনাফালাভ জড়িত। কিন্তু, কর্মীরা ক্লান্ত হচ্ছে – ব্যর্থ হচ্ছে। কর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব না দেয়াও ইউনাইটেড ম্যানেজমেন্টের এক অভ্যাস। সাম্প্রতিক সময়ে কোয়াটারলি বোনাস ব্যবস্থা তুলে দিয়ে লটারীভিত্তিক পুরস্কারের আয়োজন কর্মীদের চরম হতাশ করেছে। এই হতাশার ছাপ পড়ছে তাদের পারফর্ম্যান্সে।

এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে ফোর্বস ম্যাগাজিন বলছে “CEO Oscar Munoz and his fellow leaders are responsible for the huge gap between the company's brand identity and organizational culture. They have failed to engage, train, and motivate employees adequately and appropriately.”

অর্থ্যাৎ, ইউনাইটেডের মিশন-ভিশনে সমস্যা আছে। তাদের ঠিক করতে হবে তারা কী হতে চায়, কী করতে চায়, এবং যা হতে চায় তার অর্জনের প্রক্রিয়া কী? সবার আগে ঠিক করতে হবে – ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের কেমন ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়? এই ব্র্যান্ডের সেবা প্রদান বিষয়ক আদর্শ কী হবে? এই ব্র্যান্ড আইডেন্টিটিকে পুরো কর্পোরেশনের কালচারের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে কর্মীদের মধ্যে যে হতাশা আছে সেটা দূর করে নতুন উদ্যম আনতে হবে। কর্মীরা যেন নিজেদের প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে – এই বিশ্বাস কর্মীদের মনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষণের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

২০১৭ সালে ইউনাইটেডের সিইও অস্কার ম্যুনোজ বেশ ঘটা করে বলেছে - "United Airlines is such an iconic brand" - শুনতে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু, এই ব্র্যান্ড কীভাবে আইকনিক। এই ব্র্যান্ডের ভ্যালু প্রপোজিশন কী? অন্য ব্র্যান্ড থেকে এই ব্র্যান্ড কীভাবে আলাদা? এই ব্র্যান্ডের আদর্শগত যে অবস্থান সে অবস্থান কী ইন্টারন্যাক কর্মীবাহিনীর সাথে যথাযথ কম্যুনিকেট করা হয়েছে? ইউনাইটেডের ইউনিফরম পরে যে কর্মীরা কাস্টমার সার্ভিস দিচ্ছে, ইউনাইটেডের ব্র্যান্ড মন্ত্র কি সেই কর্মীর জামা ভেদ করে আত্মার কাছে পৌঁছাতে পারছে?
কাস্টমার সার্ভিসের বর্তমান বেহাল দশা কাটাতে এই উত্তরগুলো জানা ইউনাইটেডের জন্য খুব জরুরী।


পরিশিষ্ট –
ডেভ ক্যারলের ইউনাইটেড ব্রেকস গিটারস পৃথিবীর ছোট বড় ব্র্যান্ডদের এক শক্ত বার্তা দিয়ে গেছে। এই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় কেউ ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ নয়। একজন কাস্টমার চলে গেলে কী এসে যায় – এরকম ঘাঁড় ত্যাড়ামির দিন শেষ। এখন সবার হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট। ডেভের মতো হয়তো গায়কী নেই, কিন্তু সত্য বলার সাহস আছে ভোক্তাদের। মুহূর্তেই লাইভে চলে যাচ্ছে। যে কোনো রকম অনিয়ম আর খারাপ সার্ভিসের ভিডিও রেকর্ড থাকছে। ফলে, ব্র্যান্ডগুলোর সামনে এ এক নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। কাস্টমার ইজ দ্য কিং বলে অনেক পুরনো যে তত্ত্ব ছিল, সেটা ফিরে এসেছে আবার!


2 comments:

  1. কেউই ক্ষুদ্র নয়, তুচ্ছ নয়।

    ReplyDelete