বিজ্ঞাপনে নস্টালজিয়া

স্মৃতিকাতরতা – সুখের নাকি দুঃখের?
ফেসবুকে ভেসে বেড়ায় – Only 90s kids will understand মীম।
কিংবা ইউটিউবে “বিটিভিতে প্রচারিত কিছু ৮০/৯০র দশকের বিজ্ঞাপন দেখুন”...
আরো আছে – আলিফ লায়লা, সিন্দাবাদ, রবিনহুড, মীনা, রোবোকপের মিউজিক ট্র্যাক...
এসব ফেসবুকে শেয়ার হচ্ছে হরহামেশা, আগ্রহ নিয়ে দেখছে সবাই।

কে?

অতীতকে মনে করা? অতীতে ফিরে যাওয়ার তৃষ্ণা?
গানের ভাষায় “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম” প্রবণতা?


বলা হয়, নস্টালজিয়ার বেশিরভাগ নাকি দুঃখময় হয়; তবুও সে দুঃখ বিলাস মানুষের ভালো লাগে...
বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টন, বিনয় ঘোষের মেট্রোপলিটন মন, কিংবা হুমায়ূন আহমেদের অনন্ত অম্বরে – রচনাগুলো নস্টালজিয়া নির্ভর।
সাহিত্য বাদ।

পারিবারিক আড্ডায় কি মুরুব্বীরা প্রায়শই “আমাদের যুগে শাসন ছিল কড়া” বলে ওঠেন না?
কিংবা, পাবলিক বাসে, চায়ের দোকানে কি কোনো আঙ্কেল কথায় কথায় “একটা জেনারেশন পুরা স্পয়েলড হয়ে গেল” বলে ক্ষোভ ঝাড়েন না? সাথে কি এটাও বলেন না যে তাঁদের ছেলেবেলায় ছোটরা বড়দের সম্মান করতো, বড়রা ছোটোদের স্নেহ করতো, একের বিপদে আপদে অন্যেরা এগিয়ে আসতো; আর এখন কিছুই নেই – সব নষ্ট হয়ে গেছে?
এসব স্মৃতিচারণে ক্ষোভ আছে, বেদনা আছে – কিন্তু ভালোবাসাও আছে।

***

সুখ, দুঃখ, হাসি-তামাশা যদি বিজ্ঞাপনের ভাষা হয়, নস্টালজিয়াভিত্তিক বিজ্ঞাপনও হতে পারে?
পারে।

রেড কাউ গুড়ো দুধের বিজ্ঞাপনটির কথাই ধরি। “মনে পড়ে মনে পড়ে ফেলে আসা ছেলে বেলা, মনে পড়ে মনে পড়ে হৃদয় মেলতো পাখা” – এই জিঙ্গেলের ভেতরে বারবার মনে পড়ছে অতীত, মনে পড়ছে শৈশব। সাদাকালো ফ্ল্যাশব্যাকে ঘরে ফেরার সময় যে যুবকের মনে পড়ছে সব, মনে পড়ছে রেড কাউ; বাংলা বিজ্ঞাপনে নস্টালজিয়ার এ এক চমৎকার উদাহরণ।
উদাহরণ আরো আছে।

জুঁই নারিকেল তেলের বিজ্ঞাপনে “হারানো সেই দিন, মনে আছে যেনো এখনো সজীব যেনো হয়নি বিলীন...মনে আছে সেই নীল খাম, চিঠি?” রেডকাউয়ের বিজ্ঞাপনের মতোই জুঁইয়ের স্টোরি লাইন স্মৃতি রোমন্থন।
সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ারফেইজের “মনে পড়ে যায় আমার কৈশোর” গানে বিজ্ঞাপন করেছে বাজাজ মোটর সাইকেল (লিংক পাচ্ছি না)। এ বিজ্ঞাপনেও স্মৃতিচারণ আছে।
সুতরাং তালিকা অনেক লম্বা।

গ্লোবাল ব্র্যান্ডের দুটি বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ না করে পারছি না।

মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার তখন বাজার হারাচ্ছে। ক্রোম, ফায়ারফক্সের কাছে হেরে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। সেরকম সময়ে – বেশ ইমোশনাল সুরে এক্সপ্লোরার বিজ্ঞাপনে বলেছিল – হয়তো তোমার মনে নেই, আমাদের দেখা হয়েছিল ১৯৯০র দশকে...  হাত থেকে ফসকে যাওয়া কাস্টমার বেইজ ফিরে পেতে মাইক্রোসফট বলছিল “রিকানেক্ট উইথ দ্য নিউ ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার”।

অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস যখন অ্যাপেল পে-তে যুক্ত হলো, বিজ্ঞাপন বানালো – সে বিজ্ঞাপনেও তীব্র নস্টালজিয়া উঠে এলো।

**

প্রশ্ন হচ্ছে, স্মৃতিকাতর বিজ্ঞাপন কতোটা কার্যকরী?
নস্টালজিক অ্যাপিলের পক্ষে যারা কথা বলেন, তারা বলেন – এরকম স্মৃতিকাতরতা ব্র্যান্ডের সাথে ভোক্তার একরকম আবেগীয় সম্পর্ক (ইমোশনাল কানেকশন) তৈরি করে।
সে অতীত, ফেলে আসা অতীত, যে দিনগুলোতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না, কিন্তু সেখানে ফেরার ব্যাপক আকুলতা – সেই সময়ের সাথে সম্পৃক্ত বিজ্ঞাপন দেখে দর্শকরা নিজের সাথে অনেক মিল পান। ফলে চোখ কান পেরিয়ে বিজ্ঞাপনের দৃশ্য-কথা দর্শকের মনে পৌঁছে যায়।


অ্যাকাডেমিক গবেষকরা কী বলেন?
নস্টালজিক মার্কেটিংয়ের গবেষকরা বলেন – সাধারণতঃ কোনো জাতীয় দূর্যোগ, বিপর্যয়, বিপন্নতার পরে নস্টালজিক বিজ্ঞাপন ভালো কাজ করে।
৯/১১ টুইন টাওয়ার হামলার পরে আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে নস্টালজিক বিজ্ঞাপনের জোয়ার বইছিল। আমেরিকান জাতীয়তাবাদী মানুষের মনে ৯/১১ একটা ক্ষতচিহ্ন। এর আগের ও পরের জীবন এক নয়। কেবল স্বজন হারানোর বেদনা নয়, জাতীয় নিরাপত্তার দূর্বলতা মানুষের মনে ৯/১১ পূর্ববর্তী জীবনকে “সোনালী অতীত” চ্যাপ্টারে ফেলে দিয়েছে। ফলে, বিজ্ঞাপনে এসেছে – “Gone away are the golden days…”

 *

এখন প্রশ্ন জাগে – যে কোনো সোনালী অতীত নিয়ে বিজ্ঞাপন করলেই কি কার্যকরী হবে?
সহজ উত্তর – না, হবে না।
বিজ্ঞাপনের কিছু বেসিক ফর্মূলা আছে। সেগুলো মানতে হবে। বিজ্ঞাপনের বক্তব্যের সাথে ব্র্যান্ড ভ্যালু, কনজ্যুমার পারসেপশন, ভ্যালু প্রপোজিশন; এই ব্যাপারগুলোর সম্মিলন ঘটাতে হবে।


নেকের মনে পড়বে – ২০০৬-০৮ সময়ে গ্রামীণ ফোন, বাংলালিংক, একটেল তিনটা ব্র্যান্ডই ১৯৭১/১৯৫২ নিয়ে আবেগঘন বিজ্ঞাপন করে। সেসব বিজ্ঞাপনের আবেগ মানুষের মনকে স্পর্শ করেছে; কিন্তু মুশকিল হলো – কোনো মৌলিকত্ব নেই, কনজ্যুমার ব্র্যান্ড কানেকশন নেই। ফলে বিজ্ঞাপন থেকে গ্রামীণ ফোন বা বাংলালিংক লোগো তুলে দিয়ে একটেল বা টেলিটক, বা রুহ আফজা বা ডাচবাংলা ব্যাংক বসিয়ে দিলেও কোনো পার্থক্য তৈরি হয় না। বিজ্ঞাপনের এক্সিকিউশনে এই জেনেরিক নেচার টেলিকমের বিজ্ঞাপনে দেশের ঐতিহাসিক সংশ্লিষ্টতাকে অপ্রাসঙ্গিক করেছে। মনে আছে, সে সময় কেউ একজন পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে লিখেছিল – কর্পোরেশনগুলো দেশপ্রেম নিয়েও ব্যবসা করছে...


তাত্ত্বিকভাবে নস্টালজিয়া ২ রকম – পার্সোনাল নস্টালজিয়া, হিস্টোরিক্যাল নস্টালজিয়া।
৯/১১, ১৯৭১, ১৯৫২ – এসবই হিস্টোরিক্যাল নস্টালজিয়া।
অন্যদিকে আমাদের শৈশবের, কৈশোরের ম্যাকগাইভার, আলিফ লায়লা, রবিনহুড, শুক্রবারে বিটিভির বাংলা সিনেমা, বা রেডিওর ওয়ার্ল্ড মিউজিক শোনা – এসবই পার্সোনাল নস্টালজিয়া।

নস্টালজিক বিজ্ঞাপন নিয়ে কিছু বড়সড় সমালোচনা আছে। অন্যতম সমালোচনা হলো – নস্টালজিক বিজ্ঞাপনে আবেগ এত বেশি থাকে যে ব্র্যান্ডের ইউনিক সেলিং প্রপোজিশনটা আবেগের আড়ালে হারিয়ে যায়। বাংলা টেলিকমগুলোর বিজ্ঞাপনও এ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত।
তাহলে, উপায় কী?

**

সাফল্যের কোনো ম্যাথমেটিক্যাল ফর্মূলা নেই।
তবে, ভোক্তাসমাজের সম্মিলিত স্মৃতিচারণের (কালেক্টিভ নস্টালজিয়া) জায়গাটা ধরতে হবে, বুঝতে হবে। মানুষ সব সময় স্মৃতিচারণ করে না। একটা ঘটনা স্মৃতি হয়ে উঠতে গেলে কিছু সময় লাগে। কেউ কেউ বলেন – এক দশক বা এক যুগ পার না হলে, সেটা স্মৃতি হয় না, সেটা নিয়ে স্মৃতিচারণ করা যায় না।

আগের এক পোস্টে টপিক্যাল অ্যাড এবং আমুল বাটারের কথা বলছিলাম। টপিক্যাল অ্যাডের টেকনিক হলো চলতি ঘটনা প্রবাহকে চটজলদি ধরে ফেলতে হবে। গরমা-গরম। দু’দিন পেরুলেই আবেদন শেষ।
অন্যদিকে, নস্টালজিক বিজ্ঞাপনের জন্য স্মৃতিকে জমতে দিতে হবে। এই জমাট বাধার কোনো অপটিম্যাল টাইম ফ্রেম নেই। নিয়মিতভাবে বাজার ও ভোক্তার ওপর চোখ রাখা, পরিস্থিতির পাল্‌স ধরতে পারা, ইমোশনাল ইনটেনসিটি রিয়েলাইজ করা খুব প্রয়োজন। এই কাজটা কোকোলা নুডুলস পারেনি...
বাংলাদেশের ৯০র দশকে কোকোলা নুডুলসের “মা করছে রান্না, খেলাধুলা আর না, চল গিয়ে দেখি, মা রাঁধছে কী!” – সে সময়কার তুমুল হিট বিজ্ঞাপনের অন্যতম (লিংক পেলে পরে যুক্ত করে দেবো)। শিশু কিশোরদের মুখে মুখে ঘুরতো ছড়ার মতো।

সম্ভবতঃ ২০০০ সালের দিকে ম্যাগী নুডুলসের দাপটে কোকোলা নুডুলস বাজার হারানো শুরু করলো। এই হারানোর প্রক্রিয়া কতো বছর চলেছে জানা নেই। তবে – ঘরে ঘরে ইনস্ট্যান্ট নুডুলস জনপ্রিয় হয়েছে। টিভিতে কোকোলা নুডুলসের বিজ্ঞাপনও চোখে পড়েনি তেমন।


আরও পরে, সম্ভবতঃ ২০১০ এর দিকে, রিভিজিটিং পাস্টের ওপর ভিত্তি করে কোকোলা নুডুলস বিজ্ঞাপন বানায়, অনেকটা সিকুয়েলের মতো বিজ্ঞাপনে দেখায় ৯০র দশকের শিশুরা এখন বড় হয়েছে, মা বৃদ্ধা হয়েছেন, নতুন প্রজন্ম এসেছে; কিন্তু সে-ই কোকোলা নুডুলস খাচ্ছে সবাই। ইউটিউবে লিংক পেলাম না, তবে বিজ্ঞাপনটি টিভিতে বেশিদিন চলেনি।
আরো কয়েক বছর পরে কোকোলা নুডুলস ৯০ দশকের বিজ্ঞাপনটি পূণঃনির্মাণ করে। একই জিঙ্গেল, বক্তব্য; কেবল মানুষগুলো নতুন।


আমার অনুমান – এ বিজ্ঞাপনের পরেও কোকোলার বাণিজ্যিক সাফল্য কহতব্য নয়। এর কারণ দুটি –
১) টানা ২০ বছর ধরে দূর্বল মার্কেটিং’এর কারণে কোকোলা অনেক মানুষের মন থেকে মুছে গেছে। এমনকী নতুন প্রজন্মের ভোক্তার মনেও জায়গা নিতে পারেনি। সে জায়গাটা ম্যাগী এবং অন্য ছোটোখাটো ব্র্যান্ড দখল করেছে।
২) বিটিভির সেই মনোপলি আর নেই। ফলে, ৯০র দশকে যারা এক হিট বিজ্ঞাপনে কোকোলার ফ্যান ছিল, ২০১৫/১৬তে এসে ২৫-৩০টা বাংলা টিভি চ্যানেলের ভীড়ে সে সব দর্শক কোকোলার বিজ্ঞাপন দেখেছে কিনা সেটা প্রশ্নস্বাপেক্ষ। ইমোশনাল কানেকশন তো আরো দূরের ব্যাপার।

২০ বছর অপেক্ষা না করে কোকোলা যদি ১০ বছর পরে নস্টালজিক অ্যাপিল নিয়ে বিজ্ঞাপন বানাতো, সেটা হয়তো বেশি কার্যকরী হতো।

*

স্মৃতি মধুর।
কিন্তু, স্মৃতি বড়সড় প্রতারকও; মানুষ এবং ব্র্যান্ড দু’ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


*****

1 comment:

  1. Ami akta coughsirp add name ta mone nei bt khub sundor akta gan,pagola hoyoa ay re ay,ma r bachha vijche.bt kothao pachhi na

    ReplyDelete