ইলেকশন ক্যাম্পেইন: “ভাই, তুমি চা বানায়ে দিলা?”




সামনে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ঢাকা উত্তরের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিক।

নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে এক চা দোকানে বসে চা বানিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় পড়েছেন তিনি। ঘটনাটি ভিন্ন মাত্রার আলোচনার দাবী রাখে। তার আগে আরেকবার জেনে নিই, সেদিন কী ঘটেছিল


সোমবার বিকালে আফতাবনগরে ভোটের প্রচারের ফাঁকে ব্যবসায়ী নেতা আতিকের চা বিক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ছবি ও ভিডিও এখন সোশাল মিডিয়ায় আলোচনার খোরাক।

রামপুরা থেকে গণসংযোগ করে আফতাবনগরের দিকে যাচ্ছিলেন নৌকার প্রার্থী আতিক। এ সময় একটি টং দোকানে ঢুকে গিয়ে বসে যান চা বানাতে।

নিজের বানানো চা নিয়ে হাঁকও ছাড়েন- ‘এই চা, চা, মালাই চা, কে খাবেন?’

মেয়রপ্রার্থীর বানানো চা হাতে তুলে নিতে শুরু করেন থাকেন সঙ্গে থাকা কর্মী, সমর্থক ও দোকানে বসে থাকা লোকজন। এ সময় আতিকের চা বানানো দেখে অনেকে দারুণ কৌতূহলে ভিড় করেন ওই চা দোকানের সামনে। অনেকের মোবাইল ফোন সচল হয় ভিডিও ধারণে।

ইয়াসিন নামে একজনের টং দোকানে বসে আতিক মোট আট কাপ চা বানান। নিজের বানানো চা পরিবেশন করে বেরোনোর সময় ইয়াসিনকে ৮০০ টাকা দেন এই মেয়রপ্রার্থী।

তার এই চা বানানোর ভিডিও ফেইসবুকে তুলে তার সমর্থকরা যেমন প্রশংসা করছেন; তা দেখে অনেকে আবার ‘স্টান্টবাজি’ বলে সমালোচনাও করছেন।”

ই প্রশংসা এবং সমালোচনায় বিভক্ত দুই গ্রুপের মাঝে যুক্তির প্রভাব তেমন দেখা যায়নি। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর প্রার্থীকে পছন্দ – অপছন্দ এই দুই প্রশাখায় আলাদা হয়েছে। অনলাইনে ট্রলিং জেনারেশন বেশ কিছু মীম বানিয়েছে, কিছু পেইজ দু-তিন ছটাক বেশি লাইক কামাই করেছে, ফেসবুকের কতিপয় সেলিব্রিটিও নগর পিতা চাই, নগর মামা চাই না – বলে ব্যাপক হিট হয়েছেন, মুরীদ সম্প্রদায় মুক্ত হস্তে লাইক শেয়ার দিয়েছে।

সে রাতেই একাত্তর টিভির “একাত্তর জার্নাল” লাইভে মিথিলা ফারজানার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন আতিক। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন – একসঙ্গে চা খাওয়া গ্রাম বাংলার, বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতির ব্যাপার। মিথিলা পালটা জিজ্ঞেস করেন – আপনি ঢাকা সিটির মেয়র হিসাবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, সেখানে চা বানিয়ে খাওয়ানোর দক্ষতা কোনো কাজে লাগবে কীনা।

প্রশ্নটি ভালো ছিল, তবে এর জবাবে আতিক ব্যাপারটিকে ঠাট্টার পর্যায়ে নিয়ে মালাই চায়ে নিয়ে যান। এবং তিনি ক্রিকেট খেলেছেন বাচ্চাদের সাথে, হোটেলে খেয়েছেন; সে আলোচনায় গিয়ে নির্বাচনকালীন গণসংযোগে নতুনত্ব আনা যায় কিনা, ডিজিটাল কম্যুনিকেশনে নতুন ধারার কোনো ট্রেন্ড আনা যায় কীনা এসব বিষয় আর গুরুত্ব পায়নি। শেষতক, বাংলা কফিতে গিয়ে ঠেকেছিল।


লিটিক্যাল মার্কেটিং কিংবা পাবলিক রিলেশন নিয়ে যারা আগ্রহী তারা এ বিষয়টি নিয়ে অ্যাকাডেমিক এবং প্র্যাকটিক্যাল আলোচনা করতে পারতেন। সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের অপ্রদর্শিত একটা বিশাল বাজেট থাকে। সে বাজেটের কতো অংশ কম্যুনিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয় তার হিসেব আছে কিনা জানি না। তবে – ভ্যালু প্রপোজিশনের (নির্বাচনী ওয়াদা) পাশাপাশি একটা কম্পারিটিভ অ্যাডভার্টাইজিং (অমুক প্রার্থী তমুক প্রার্থীর চেয়ে ভালো) খুব দৃশ্যমান। গত কয়েক নির্বাচনে গানের একটা জোয়ার এসেছে। সেটা ২০১৪ সালের “জয়বাংলা বলে আগে বাড়ো” বা ২০১৮ সালের “জিতবে নৌকা, জিতবে জনগণ” কিংবা ঘটা করে নির্বাচনী গানের সিডি প্রকাশও হতে পারে -








 
হতে পারে “ডেইজি আপার সালাম নিন”-এর মতো একেবারে প্রার্থী পর্যায়ের প্রচারণা


ত ৩০ বছরে ইলেকশন কম্যুনিকেশনের ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচে’ সফল (অপ)প্রচারণা ছিল বিএনপি’র। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে এটিএন বাংলায় বি চৌধুরীর উপস্থাপনায় “শাবাস বাংলাদেশ” অনুষ্ঠানটি ব্যাপকভাবে ভোটার টেনেছিল। একই নির্বাচনে ভোটের আগের দিন তুমুল জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা যায়যায়দিনের সম্পাদক শফিক রেহমান “এক কোটি তরুণ ভোটারের কাছে আবেদন” নামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে তরুণ ভোটারদের কাছে চমৎকার একটি চিঠি লিখেছিলেন। 'আমার তরুণ বন্ধুরা, আমার তরুণ বান্ধবীরা' ডেকে 'তুমি' সম্বোধনের অনুমতি নিয়েছিলেন। তারপর নানান ছলে চার-দলীয় জোটের জন্য ভোট চেয়েছিলেন। 'অমুক দলকে ভোট দিও' এমন কথা তিনি সরাসরি বলেননি। তিনি তুলনা করেছিলেন, সে সময়কার দুই নেত্রীর, দুই অর্থমন্ত্রীর, দুই দলের ক্ষমতার দুই টার্মের। তারপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন তরুণ বন্ধু ও তরুণী বান্ধবীদের উপর। শেষে ছোটো ছোটো বাক্যে বলেছেন - 'কারো কথায় ভয় পেয়ো না', 'সকাল সকাল কেন্দ্রে যেও', 'আগে আগে ভোট দিও'। কিন্তু মাঝে দেখিয়েছেন দূর্দান্ত কিছু স্বপ্ন, প্রচ্ছদের অলংকরণের মডেল তরুণ তরুণী জীবন। শফিক রেহমান খালেদা জিয়ার ভাষণ লিখে দিতেন, উপদেষ্টা ছিলেন; এটা গোপন কিছু ছিল না। তবে, মিস্টার রেহমানের সে চিঠি বিপুল সংখ্যক সুইং ভোট বিএনপির পকেটে এনে দিয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ইলেকশন কম্যুনিকেশন কেমন হওয়া উচিৎ, একজন প্রার্থী ভোট পেতে কী করবেন; এগুলো পরিকল্পিতভাবে হওয়া উচিত। এলাকা ঝাড়ু দেয়া, দোকানে চা খাওয়া, কিংবা কৃষকের ঘরের দাওয়ায় বিনা নোটিশে পানতা ভাত খেতে বসে যাওয়া খুব ক্লিশে।

সময় পাল্টেছে।

নতুন জেনারেশনের ভোটার এসেছে।

হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, ফোর জি; এসবই পুরনো।

তাই নতুন সময়ে নতুন গল্প, নতুন ক্যাম্পেইন, নতুন কম্যুনিকেশন স্ট্র্যাটেজি দরকার।

এই তীব্র তাগিদের কাছে আতিকের চা বানানোর ঘটনা নতুনত্ব আনতে পারেনি, আস্থা আনতে পারেনি, ট্রলার সোসাইটি তাই লুফে নিয়েছে।

প্রসঙ্গে ফ্রেশ নাম্বার ওয়ান চা’র বিজ্ঞাপনটি মনে পড়লো।
জনগণের প্রত্যাশা মেটাতে নির্বাচনী প্রার্থী চা-দোকানী (মোশাররফ করিম) যখন চা বানিয়ে দিচ্ছেন, তখন একজন বলে ওঠেন – “ভাই, তুমি চা বানায়ে দিলা?”
জবাবে দোকানী বলেন – “এককাপ চা-ই যদি বানায়া খাওয়াতে না পারি, কমিশনার হওয়ার পরে কী করুম?”



এ বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার (সম্ভবত তৌহিদ মিল্টন) খুব স্মার্টলি যে কাজটি করেছেন তা হচ্ছে, চা বানানোই শেষ নয়, এই চা বানানো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। জনগণকে সেবা করার একটা সৎ চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে।

ঢাকার মেয়র প্রার্থী মিস্টার আতিক এ জায়গাটা মিস করে গেছেন।
৮ কাপ চা ৮০০ টাকায় বিক্রি শেষে তিনি যদি বলতেন, এটা শেষ নয় – শুরু মাত্র। নির্বাচনে জিতলে প্রথম ১০০ শুক্রবারে ঢাকা উত্তরের ১০০টি এলাকার চা দোকানে দিয়ে জনগণকে নিয়ে চা খাবেন। জনগণে সমস্যার কথা শুনবেন। এটা একটা নির্বাচনী ওয়াদা হতে পারতো।

মার্কেটিং কম্যুনিকেশনে যে ইউনিক মেসেজের কথা বলা হয়, ইউএসপির কথা বলা হয়, সল্যুশন টু দ্য পেইনের কথা হয়; সে সব কিছুর চমৎকার সমন্বয় হতে পারতো এই চা কাহিনী।


No comments:

Post a Comment