বিজ্ঞাপনের নান্দনিকতা ও রুচিবোধ প্রসঙ্গ

মেরিন সিটি মেগা শপিং কমপ্লেক্স-এর একটি বিজ্ঞাপন ফেসবুকে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে।

ঠিক পজিটিভ অর্থে নয়, বরং বিজ্ঞাপনের মডেল, তাদের শব্দ চয়ন, সর্বোপরি বক্তব্যের চটুলপনায় বেশ হাসি তামাশার খোরাক জুগিয়েছে।
***

আমার পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞাপনটি সফল।
সাফল্য নির্ভর করে উদ্দেশ্যের ওপর;
অনুমান করি, মেরিন মেগা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের নাম চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া। সেক্ষেত্রে, সাফল্য আশাতীতই হওয়ার কথা।
***

এবার আসি অ্যাকাডেমিক ব্যাখ্যায়...

এই বিজ্ঞাপনের টার্গেট মার্কেট কারা?
কক্সবাজারের বাসিন্দারা। (বিজ্ঞাপনে বলা আছে এখন আর ঢাকা গিয়ে শপিং করতে হবে না।)
বিজ্ঞাপনের শেষেও কক্সবাজারের বাসিন্দাদের আহবান করা হয়েছে...

যদিও ব্যাপারটা পরিস্কার হয়নি, শেষের দিকে এক ভদ্রমহিলা বলছেন তিনি কক্সবাজার গেলেই মেরিন মেগাসিটি থেকে কেনাকাটা করেন।


অর্থ্যাৎ, অনুমান করা যেতেই পারে তিনি কক্সবাজারে থাকেন না। ফলে, দর্শকদের মনে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা জন্মে যে কক্সবাজারে ঘুরতে গেলে মেগাসিটিতে যাওয়া যায়...
ঠিক এখানেই এই বিজ্ঞাপনের সবচে' স্মার্ট এক্সিকিউশন; 'লিংক রোড' শব্দদুটো একাধিকবার উল্লেখ করে লোকেশন জানানোর একেবারে মোক্ষম কার্যকারিতা।

৯৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটিতে আছে স্টোরিলাইন (যদিও সিভিলাইজড দর্শকদের কাছে গল্পটি বালখিল্য), আছে ভ্যালু প্রপোজিশন (সব কিছু পাওয়া যায়, সব কিছু), আছে পারসুয়েশন (ভিজিটের উদ্দাত্ত আহবান)।
যদি একটি ভালো বিজ্ঞাপনের কোনো চেকলিস্ট থাকে, এ বিজ্ঞাপন সব বক্সে টিক দিয়েছে। অ্যাওয়ারনেস তৈরি করার জন্য স্বল্পবাজেটে (আমার অনুমান) এরচে' বেশি আর কী দরকার?
প্রচারেই প্রসার। থ্রি চিয়ার্স ফর মেরিন মেগা সিটি শপিং কমপ্লেক্স!

***

এখন অন্য একটা কল্পনা করি।
ভাবুন, একই টাইপের বিজ্ঞাপন বসুন্ধরা শপিং বা যমুনা ফিউচার করলো।
সেটা কিন্তু বসুন্ধরা বা যমুনার জন্য সাড়ে সর্বনাশ হবে।
কারণ হলো, শপিং মল/রিটেইল ইমেজ। বইয়ের ভাষায় যাকে 'ব্র্যান্ড পারসোনালিটি' বলা হয়, বসুন্ধরা ও যমুনার সেরকম আলাদা পারসোনালিটি আছে। এই পার্সোনালিটি দেখা যায় না। ভোক্তারা অনুভব করতে পারেন। মার্কেটিং গুরু ডেভিড আকার এবং তাঁর কন্যা জেনিফার আকার ব্র্যান্ড পারসোনালটির বিভিন্ন মাত্রা বা স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। এর মধ্যে বিগ ফাইভ খুব পপুলার।

ঢাকা নিউ মার্কেটের, ইস্টার্ণ প্লাজার, গুলশান ডিসিসি মার্কেটের সবার নিজস্ব ইমেজ (পারসোনালিটি) আছে। ভোক্তারা নিজের পারসোনালিটির সাথে খাপ খায় এমন মার্কেটে যেতে ঘুরতে কিনতে পছন্দ করেন।
ছোট্ট উদাহরণ, নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষটি গাউছিয়ার কোলাহল ধাকাধাক্কি পছন্দ করবেন না। তিনি বরং আড়ং এর ফিক্সড প্রাইসের জিনিসটি অল্প সময়ে কিনে ঘরে ফিরবেন।

যে প্রসঙ্গে ছিলাম -
বসুন্ধরা-যমুনা এরকম বিজ্ঞাপন করলে এদের টার্গেট মার্কেট ইনসাল্টেড ফিল করবে। ফেসবুক নিউজফীডে যখন এরকম ইনকনগ্রুয়েন্ট বিজ্ঞাপন ভাসছে, তখন কে-ই বা 'শপিং ইন বসুন্ধরা/যমুনা' স্ট্যাটাস দেয়ার রিস্ক নেবে?

ফলে, যমুনা বা বসুন্ধরা বা ইস্টার্ন প্লাজা এরকম বিজ্ঞাপনে নিজেদের ইমেজ সংকটে ফেলবে না।
(এ পর্যায়ে এসে মনে পড়লো নব্বইয়ের দশকে ইস্টার্ন প্লাজা, পীর ইয়ামেনি মার্কেট, রাজধানী সুপার মার্কেট বিটিভিতে বিজ্ঞাপন দিতো।)

***

মেরিন সিটির প্রসঙ্গে ফিরে যাই -
ব্র্যান্ড পারসোনালিটি খর্ব করার যে ঝুঁকি আড়ং, যমুনা, বসুন্ধরার রয়েছে; মেরিন সিটির তা নেই। প্রথমত: তারা নিউকামার, টার্গেট মার্কেটের ইমেজ সেনসিটিভিটি তুলনামূলকভাবে কম, এবং শুরুতে তাদের একটা কাস্টোমার ট্রাফিক দরকার। সব মিলিয়ে - এক বিজ্ঞাপনেই "হারানোর কিছু নেই" জাতীয় একটা সাহস আছে।
ফরচুন ফেভার্স দ্য ব্রেভ।

***

আলাপ যেহেতু লম্বা হচ্ছে, আরেকটু কথা বাড়াই -

ধরুন, সেইম টার্গেট মার্কেটের জন্য সেইম বিজ্ঞাপন করা হলো, একটা নতুন ব্র‍্যান্ডের সাবান অথবা শ্যাম্পু অথবা জুতা।
এখানে একেবারে হারু পার্টি হওয়ার ব্যাপক রিস্ক আছে।
লক্ষ্য করুন - মেরিন সিটি মূলতঃ একটি ছাদ, এর নিচে আপনি আপনার পছন্দের ব্র‍্যান্ড (ধরি, ক্লোজ আপ টুথপেস্ট) কিনছেন। আপনি মেরিন সিটি নামক কোনো পণ্য কিনছেন না। সেক্ষেত্রে মেরিন সিটির "বালখিল্য" স্টোরিলাইন আপনাকে আক্রান্ত করছে না। মেরিন সিটিতে পা দিয়ে আপনি হয়তো বার্মিজ আচার চকলেট লুঙ্গি স্যান্ডেল কিনছেন; ৯৫ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনের নান্দনিক দূর্বলতা আপনাকে মোটেও স্পর্শ করছে না।

অন্যদিকে যদি মনে পড়ে - লতা হারবালের সেইসব বিজ্ঞাপন, তবে নিশ্চয় একমত হবেন - বিজ্ঞাপন দেখেই পণ্য কেনার রুচি হারিয়ে গিয়েছিল আপনার!

***

এবার কথা শেষ করি -

এ সপ্তাহেই আরেকটি বিজ্ঞাপন ফেসবুকে শেয়ার হয়েছে - মেসার্স ওছমান ইলেকট্রনিকস, মাকেশ্বর বাজার, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল।


বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনের তরুণ দম্পতির সংসার। টিভিতে সাউন্ড নেই, ফ্রিজের দরজা ভেঙে পড়ে গেছে, ফলে স্ত্রী রাগ করে টিভিও ভেঙে ফেলছে এবং রাগ করে সম্ভবত বাপের বাড়ী চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে স্বামী তাকে কাতর স্বরে ডাকছে।

ঠিক তখনি দৃশ্যে আসে আরেক দম্পতি।
থিওরিতে আমরা যাকে ব্র‍্যান্ড অ্যাডভোকেট বলি, তারা সেই রোল প্লে করে। পজিটিভ ওয়ার্ড অব মাউথের মুখরতায় তারা 'ভিশন' ব্র্যান্ড সাজেস্ট করে, মাকেশ্বর বাজারের শো-রুমের কথা বলে। পরের দৃশ্যে দেখা যায় ঝগড়ারত দম্পতি ভিশন টিভি কিনেছে, সেখানে তারা 'বন্ধু আমার পানের দোকানদার' শুনছে। ঝগড়ার বদলে খুনসুটিতে স্বামীর মুখে স্ত্রী পান তুলে দিচ্ছে...

দুই মিনিটের বিজ্ঞাপনটির নির্মানও নান্দনিক নয়। তবে এতে কনজুমারের পেইন টু প্লেজার ট্রানসফর্মেশন দেখানো হয়েছে, এতে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। ফলে বিজ্ঞাপন কন্ঠের 'স্লিং ফ্যান' 'ব্লিন্ডার' আঞ্চলিকতা নাকি উচ্চারণ ত্রুটি - সে জিজ্ঞাসা গৌণ হয়ে যায়।

আমার অনুমান - মেসার্স ওসমান ইলেকট্রনিকসের বিজ্ঞাপনটি ঘাটাইলের লোকাল ভিডিও চ্যানেলে দেখানো হয়।

এটা হয়তো মার্কেটিং কমুনিকেশনে এক নতুন ধারা আনবে। ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলে টাকা না ঢেলে অল্প বাজেটে লোকাল চ্যানেলে এবং ফেসবুকে, লোকাল ভাষায়, লোকাল চেহারার মানুষ নিয়ে বিজ্ঞাপন হয়তো তুচ্ছ করে দিবে মিলিয়ন ডলারের সেলিব্রিটি এন্ডোর্সমেন্ট!

দিন শেষে কোন পণ্য কেমন বিক্রি হলো সেটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। বটম লাইনে কন্ট্রিবিউট করতে না পারলে অ্যাওয়ার্ড উইনিং বিজ্ঞাপন ধুয়ে পানি খেয়ে লাভ নেই।

তাই আবারও মেরিন সিটিকে অভিনন্দন। মেসার্স ওছমান ইলেক্ট্রনিক্সের জন্য শুভ কামনা

*
১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

No comments:

Post a Comment