সিনেমার
নাম Kaaka Mutai (The Crow’s
Eggs).
তামিল
ছবি।
সিনেমার
প্রেক্ষাপট দেখে মনে হতে পারে – স্লামডগ মিলিওনেয়ারের পাশের বস্তির গল্প।
যারা
সিনেমাটি দেখেননি, কিন্তু দেখার ইচ্ছা রাখেন – তারা এই লেখার বাকী অংশ না পড়াই
ভালো। বাকী অংশে স্পয়লার আছে। তাই এখানেই থামতে পারেন :)
দ্য
ক্রো’স এগস নাম, কারণ এই সিনেমার বস্তিবাসী দুই শিশু কাকের ডিম খায়। এবং নিজেদের
যথাক্রমে ছোট কাকের ডিম ও বড় কাকের ডিম বলে পরিচয় দেয়।
তাদের
বাবা হাজতবাসী। ঘরে মা আর দাদী। বস্তিজীবনের চরম দারিদ্র্যের মাঝে তাদের জীবন
যাপন। দুই ভাই কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। দূর্বার – দূরন্ত।
মূল
গল্প শুরু হয় যখন তাদের বস্তির পাশে এক পিজ্জা চেইনের আউটলেট খোলে। নাম – পিজ্জা স্পট।
দুই ভাইয়ের মধ্যে তুমুল আকাঙ্ক্ষা – পিজ্জা খেতে কেমন, গন্ধ কেমন, স্বাদ কেমন?
গ্লসি
পেপারের লিফলেট পকেটে নিয়ে তারা ঘুরে – তিনশ’ (২৯৯) রুপি লাগবে পিজ্জা কিনতে। তাই
তারা ৩০০ রুপি রোজগারে নামে। ১০-২০ করে রুপি জমায়। একদিন ৩০০ রুপি হয়ে যায়।
কিন্তু, ময়লা জামার কারণে পিজ্জা স্পটের দারোয়ান তাদের ঢুকতে দেয় না।
এরপর
দুই ভাই নতুন জামা কেনার মিশনে নামে। নানান ঘটনা পেরিয়ে নতুন জামা গায়ে চাপে।
কিন্তু, এবারও পিজ্জা স্পটের দারোয়ান তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয় না। বরং, চড় মেরে
মাটিতে ফেলে দেয়।
এই
চড় মারার দৃশ্য মজা করে মোবাইলে ভিডিও করে বস্তির আরেক কিশোর। এবং সেই ভিডিও চলে
যায় স্থানীয় পাতি-মাস্তানের হাতে। পাতি মাস্তানের লক্ষ্য – এই ভিডিও দেখিয়ে পিজ্জা
স্পটকে ব্ল্যাকমেইল করা যাবে, বিনিময়ে নগদ অর্থ (হয়তো ৫০০০ রুপি) আদায় করা যাবে।
অনাকাঙ্ক্ষিত
ঝামেলা এড়াতে পিজ্জা স্পট কর্তৃপক্ষ ১ লাখ রুপি অফার করে। কিন্তু, পাতিমাস্তানের পরিকল্পনা
ভন্ডুল হয়ে যায়। ততক্ষণে ঐ ভিডিও ক্লিপ চলে গেছে টিভি চ্যানেলের হাতে।
টিভিতে
বারবার দেখানো হচ্ছে বস্তির শিশুকে চড় মারার ভিডিও। টক শো’তে সুশীল সমাজের
বুদ্ধিজীবিরা উত্তেজিত। একদিকে এই ঘটনার রাজনীতিকরণ যখন ঘটছে, তখন পিজ্জা স্পটের
কর্তাদের কপালে ভাঁজ। যখন চেইন রেস্টুরেন্টটির বিস্তৃতি ঘটছে, নতুন শহরে নতুন নতুন
আউটলেট খোলা হচ্ছে, তখন এই চড় কান্ডের মিডিয়া প্রেশার কীভাবে সামাল দেবে পিজ্জা
স্পট?
সিনেমায়
আমরা দেখি – রাজনৈতিক পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা বস্তিবাসী, জনপ্রতি ১০০ রুপির বিনিময়ে,
পিজ্জা স্পটমুখী মিছিলে সামিল হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই আগুনে কে কোন দিক থেকে
আলু পুড়িয়ে খাবে সেই প্রস্তুতি চলছে।
তখন
দৃশ্যপটে আসে পুলিস।
দুই
ভাই ও তাদের মাকে গাড়ি করে নিয়ে যায় পিজ্জা স্পটে। সেখানে সমবেত জনগণ, মিডিয়ার
ক্যামেরা ক্রু, সাংবাদিকদের হাতে মাইক্রোফোন। সব কিছু ছাপিয়ে লাল গালিচা আর
ব্যান্ড পার্টির ছন্দে বড় কাকের ডিম আর ছোট কাকের ডিম – এই দুই ভাইকে রাজকীয়
সম্মানে পিজ্জা স্পটের ভেতরে নিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ। ঘোষণা দেয়া হয় – আজীবন তারা
সেখানে ফ্রি পিজ্জা খেতে পারবে। কর্তৃপক্ষ বিনম্র আদরে দুই ভাইয়ের মুখে পিজ্জার
স্লাইস তুলে দেয়। এই প্রথম বারের মতো পিজ্জার স্বাদ পায় তারা। চারপাশে তখন বিপুল
করতালি, ক্যামেরার ক্লিক।
রাজনৈতিক
পেশি শক্তির যে শো-ডাউনের প্রস্তুতি ছিল তা ভেস্তে যায় পিজ্জা স্পটের ক্রাইসিস
ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজির কাছে। যদিও এর পরে টিভি সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুলেছে - শিশু দুটিকে এভাবে ডেকে, মুখে পিজ্জা তুলে
দিয়ে, আজীবন ফ্রি খাওয়ার অফার দিয়ে – পিজ্জা স্পট কি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করলো
না? এগুলো কি জনগণের আই-ওয়াশ নয়?
প্রশ্নের
জবাবে আরেক চাল চালে পিজ্জা স্পট। তারা জানায় – এসব কিছু তাদের সামাজিক
দায়বদ্ধতারই অংশ। দারিদ্র্যের অগমে দূর্গমে নিমজ্জিত বস্তির পাশে দোকান খুলে তারা
মূলতঃ পিজ্জাকে সবার জন্য সহজলভ্য করার চেষ্টায় আছে। এমনকী, এখন থেকে পিজ্জা স্পটে
৪৫ রুপির পিজ্জাও পাওয়া যাবে। (হাততালি)।
সব
মিলিয়ে পিজ্জা স্পটের জয়।
প্রশ্ন
আসতে পারে – পুলিস কি স্বতোঃপ্রণোদিত হয়ে পিজ্জা স্পটের পাশে দাঁড়িয়েছে? উত্তর
সম্ভবতঃ “না”। কারণ, সংকট চলাকালীন সময়ের এক সংলাপেই শোনা যায় – পুলিসকে যতো টাকা
অফার করা হবে, পুলিস তার দ্বিগুণ চাইবে।
অর্থে
বা সম্পর্কে – যেভাবেই হোক না কেন, দ্য ক্রো’স এগস সিনেমায় পিজ্জা স্পট এক বিশাল
ক্রাইসিস সামাল দিতে পেরেছে। বিশেষ করে ৪৫ রুপির পিজ্জা প্রকল্প অনেকের মুখ বন্ধ
করে দিয়েছে।
দ্য
ক্রো’স এগস সিনেমার মূল গল্পে পিজ্জা আছে, দারিদ্র্য আছে, দারিদ্র্য যাপন আছে,
মৃত্যু আছে, দুঃখ আছে – হয়তো দারিদ্র্যের বিপননও আছে। যারা সিনেমাটি দেখেননি,
কিন্তু শুরুর সতর্কতা সত্ত্বেও এই লেখা এতটুকু পড়ে ফেলেছেন, তাদের জন্য বলছি - এই
ব্র্যান্ড ক্রাইসিস পুরো সিনেমার খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ। ব্র্যান্ড, বিজ্ঞাপন, ও
কনজ্যুমার বিহেইভিয়ারের পাঠক-পর্যবেক্ষক হিসেবে সিনেমার এ অংশটুকু ‘বিজ্ঞামন’-এ
টুকে রাখার জন্য এ লেখা।
সিনেমাটিতে
পিজ্জা স্পটের যে ব্র্যান্ড ক্রাইসিস, সেটা খুব নতুন কিছু নয়। বাস্তব জগতে
ব্র্যান্ডগুলো নানান রকম সংকট এবং স্ক্যান্ডালের শিকার হচ্ছে। ফেসবুক, ফক্সভাগেন,
মালেশিয়ান এয়ার বাদ দেই। বাংলাদেশেই প্রাণ ব্র্যান্ডের ভেজাল, আড়ং-এর প্রাইস ট্যাগ,
পারসোনার মেয়াদউত্তীর্ণ প্রসাধনী, বা তাদের গোপন ক্যামেরা কেলেঙ্কারি, নর্থ সাউথে
জঙ্গীবাদ, পাঠাও-এর গোপন এসএমএস পাঠ – এরকম আরো অনেক অনেক ঘটনা ব্র্যান্ড
ক্রাইসিসের উদাহরণ। এ সংকটগুলো কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে সামালের চেষ্টা চলে।
কখনো বা অন্য হাজার ঘটনার আড়ালে বিস্মৃত হয়ে যায়।
কয়েক
বছর আগে একটি নামকরা রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের তৈরি করা একাধিক ভবনে ফাটল ধরেছিল,
এমনকী একটি ভবন একটু হেলেও পড়েছিল। এ নিয়ে প্রধান এক দৈনিক পত্রিকা ধারাবাহিক
প্রতিবেদন ছাপানো শুরু করলো। কিন্তু, ৩ দিন পরেই আর কোনো খবর নেই। বরং, পত্রিকাটির
১ম পাতায় ও শেষ পাতায় প্রায় দশদিন ব্যাপী ঐ রিয়েল এস্টেটের বিজ্ঞাপন ছাপা হলো। এমনকী
ব্যবসাপাতা বা উপসম্পাদকীয় বিভাগে কোম্পানীটির মালিকের এক বিশাল সাক্ষাতকার ছাপা
হলো। সেখানে পাঠকরা জানলো, দেশের আবাসিক সমস্যার উন্নয়নে কী দূর্দান্ত কাজ করছে ঐ
কোম্পানী।
বাজারে
গুজব ছিল – কেবল ঐ একটি দৈনিক ‘ম্যানেজ’ করতে কোম্পানীটি ৫ কোটি টাকা খরচ করেছিল।
সে
তুলনায়, দ্য ক্রো’স এগস সিনেমার পিজ্জা স্পটের মুন্সিয়ানা কম প্রশংসার যোগ্য না।
No comments:
Post a Comment