জ্যাকি পেইজ |
নাম জ্যাকি পেইজ।
বয়স ৭৭। থাকেন ইংল্যান্ডের স্যুরেতে।
এই বৃদ্ধা দাবী করছেন গত ৬০ বছর ধরে পানীয় হিসেবে তিনি কেবল পেপসিই পান করছেন।
পানি কিংবা দুধ কিছুই না, তিনি কেবল পেপসিই পান করেন।
সংখ্যার
বিচারে তিনি প্রায় ৯৩ হাজারের বেশি পেপসি ক্যান এ পর্যন্ত গিলেছেন। বলছেন,
এতে করে তার কোনো শারীরিক সমস্যা হচ্ছে না। সব কিছু ঠিকই আছে। এখনো সকালে
ঘুম থেকে উঠে চা কফি না, ফ্রিজ থেকে এক ক্যান পেপসিতে চুমুক দেন তিনি।
চমকপ্রদ খবরটি ইন্টারনেট বিশ্বে পাঠকের আগ্রহ তৈরি করেছে।
জ্যাকি বলছেন - এটা কোনো অ্যাডিকশন নয়, পেপসি তার ভালো লাগে।
প্রশ্ন জাগে, পেপসির সাথে জ্যাকির এই সম্পর্ক কি শুধুই ভালো লাগা? ভালোবাসা?
এটা কি এক রকম নেশা (অ্যাডিকশন) নয়?
*
আলোচনা করা যাক - অ্যাডিকশন কী?
এর কি কোনো সংজ্ঞা আছে?
সাইকোলজি লিটারেচারে প্রচুর সংজ্ঞা আছে। আলোচনার সুবিধার্থে সংজ্ঞাগত বিশ্লেষণে গেলাম না।
মোটা
দাগে বলা হয় - অ্যাডিকশন হলো কোনো বিষয় বা বস্তুর জন্য শারীরিক ও মানসিক
আকাঙ্ক্ষা, যেই আকাঙ্ক্ষা চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।
অর্থ্যাৎ, অ্যাডিকশন কোনো ভালো কিছু নয়।
আসলেই
তো! অ্যাডিকশনের প্রসঙ্গ আসলে - স্বভাবতই নিগেটিভ বিষয়গুলোর প্রাধান্য
লক্ষণীয়। যেমন, মদের নেশা, সিগারেটের নেশা, টাকার নেশা; অর্থ্যাৎ যাবতীয়
নেশাই ক্ষতিকর।
মানুষ
আরও অনেক কিছুর প্রতি অ্যাডিক্টেড হয় - মাত্রাতিরিক্ত গান শোনা, সিনেমা
দেখা, ব্যায়াম করা, ভিটামিন ট্যাবলেট খাওয়া, ভিডিও গেইমস খেলা; এমনকী নিজের
আদর্শিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস অন্যের ওপর প্রয়োগের অনর্গল চেষ্টাও অ্যাডিকশন
বলে ধরা হয়।
তাহলে, আমরা "মাত্রাতিরিক্ত" শব্দটার ওপর নজর রাখতে পারি।
*
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার ক্ষতিকর নয়। কিন্তু, মাত্রাতিরিক্ত হলে? অনেকেই মানবেন - ক্ষতিকর।
ছবি আপলোড করার পরে কতোটা লাইক পড়লো; এই লাইক গোণা, লাইক ভিক্ষা করা, বা লাইক কুড়ানো কি অ্যাডিকশন নয়?
আবারও "মাত্রাতিরিক্ত" শব্দটার কাছে ফিরে যাই। যদি, লাইক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মাত্রাতিরিক্ত হয় -- সেটা অ্যাডিকশন।
ক্ষতি
কী বা কীভাবে হয়? মানসিক। যারা লাইক পেয়ে পেয়ে অভ্যস্ত, তারা লাইক না পেলে
বা লাইক পাওয়া কমে গেলে - কী যেনো কি নেই অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়। ক্ষণে
ক্ষণে রিফ্রেশ বাটনে চাপ দিয়ে দেখে নতুন কোনো নোটিফিকেশন এলো কীনা। এটাই
অ্যাডিকশন।
*
সাইকোলোজি'তে অ্যাডিকশন নিয়ে অনেক অনেক গবেষণা হয়েছে।
কী কারণে, কীভাবে মানুষ কোনো বিষয়ে নেশাগ্রস্ত হয় সে নিয়ে লেখালেখি হয়েছে।
মদ,
সিগারেট, পর্ণোগ্রাফি, ওজন কমানোর ঔষধ খাওয়া থেকে শুরু করে - প্লাস্টিক
সার্জারী, অতিরিক্ত ভোজন, দোকানে গিয়ে চুরি করা; এসবই অ্যাডিকশন রিসার্চের
আওতায় এসেছে।
১৯৯০'র দশকের মাঝামাঝি এক ধরণের কাস্টোমারের দিকে গবেষকদের নজর গেল।
এইসব
কাস্টোমাররা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা করছেন। আরও পরে যখন ইন্টারনেট
জনপ্রিয় হলো, অনলাইনে কেনাকাটার সুযোগ এলো দেখা গেল - একদল মানুষ নেশা
গ্রস্তের মতো জিনিশপত্র কিনছেন। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সবই কিনছেন। ভালো
মন্দের দু'দিকই আছে। যেমন ধরুন -- অনেকে কেবল বই কিনছেন আর কিনছেন, বই কিনে
ঘর ভর্তি করে ফেলছেন; অথচ পড়ার সময় পাচ্ছেন না। তবুও কেনা থামছে না।
"ভালো লাগছে না, একটু মার্কেট থেকে ঘুরে আসি" - এরপরে একগাদা কেনাকাটার পরে মন ভালো হয়ে গেল। এরকম কি অনেকের ক্ষেত্রে ঘটে না?
এটা কি নেশা বা অ্যাডিকশন নয়?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে - গবেষকরা দেখছেন, মানুষ ব্র্যান্ডের প্রতিও অ্যাডিক্টেড হচ্ছে।
ভোক্তার সাথে ব্র্যান্ডের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা অনেক পুরনো। এসব গবেষণায় দেখা গেছে -
কেউ ব্র্যান্ড নিয়ে সন্তুষ্ট হয় (Brand satisfaction)
কেউ ব্র্যান্ডের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে (Brand trust)
কেউ ব্র্যান্ডের প্রতি অনুগত হয় (Brand loyalty)
কেউ ব্র্যান্ডের সাথে ঘনিষ্ঠ হয় (Brand attachment)
কেউ ব্র্যান্ডকে ভালোবাসে (Brand love)
কেউ ব্র্যান্ডকে পাওয়ার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে (Brand passion)
কেউ ব্র্যান্ডের কথা অন্যদের সাথে আলাপ করে (Word-of-mouth)
কেউ কেউ আবার আরো এক ধাপ এগিয়ে অনলাইনে অফলাইনে ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করে (Brand advocate) ।
উপরের
সম্পর্কগুলোর তীব্রতা ও ধরণ একেকজনের জন্য একেক রকম হয়। এ বিষয়গুলো
মার্কেটিং লিটারেচারে প্রতিষ্ঠিত কনসেপ্ট।
স্যাটিসফ্যাকশন মানেই লয়াল নয়, আবার লয়্যাল মানেই ব্র্যান্ড অ্যাডভোকেসি
নয়। একটা ব্র্যান্ডকে আমি ভালোবাসি, তাই বলে অনলাইন ফোরামে এই ব্র্যান্ডের
ফ্যানবয় হয়ে অন্যদের সাথে ফাইট করবো তা কিন্তু নয়। আবার করতেও পারি।
ব্যাপারটা এরকম।
তাহলে,
ব্র্যান্ড অ্যাডিকশনের ব্যাপারটা কী? উপরে যে ৮টা কনসেপ্টের কথা বলা হলো -
ব্র্যান্ড অ্যাডিকশন এদের চেয়ে কতোটা ভিন্ন বা অভিন্ন?
আচরণগত দিক থেকে মিল কিছুটা আছেই।
অ্যাডিকশন
শুরু হয় কীভাবে? শুরুতে পছন্দ, তারপরে ভালোলাগা, ভালোবাসা, পাওয়ার তীব্র
আকাঙ্খা, ঘনিষ্ঠতা - - - ক্রমান্বয়ে ব্র্যান্ডের প্রতি এক রকম ঘোর লাগা
তৈরি হয়। এই ঘোর বা আবেশে আচ্ছন্ন হওয়ার ফলে ব্রেইনের মধ্যে যে ক্রিয়া
প্রতিক্রিয়া ঘটে তা অনেকটা মাদক বা সঙ্গীতের আকাঙ্ক্ষার মতো। ঘোর লাগা আবেশ
এবং আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবের রূপান্তরের তীব্রতা এবং পেয়ে গেলে না হারানোর বা
ধরে রাখার ঐকান্তিক চেষ্টা; এসবই ব্র্যান্ড অ্যাডিকশনের প্রকাশ।
একজন মাদকাসক্ত যেমন নিজের আসক্তির ব্যাপারটা বোঝে না, তেমনি ব্র্যান্ড অ্যাডিক্ট ভোক্তাও নিজের অ্যাডিকশনের ব্যাপারটা টের পান না।
শুরুতে জ্যাকি পেইজের কথা বলছিলাম। সাক্ষাতকারে তার দুটো বক্তব্য উল্লেখযোগ্য - প্রথমে তিনি বলছেন "I don't call it an addiction. It's just something I like, and I can't help it if I don't like anything else." একটু পরে আবার বলছেন - "Whether I am a caffeine addict or not I don't know, but I am 77 years old and I have survived so far."
তিনি নিজে কতোটা জানেন বা স্বীকার করবেন সে প্রসঙ্গ বাদ রাখলে থিয়রেটিক্যালি বলা যায় - জ্যাকি ব্র্যান্ড অ্যাডিক্ট।
*
জ্যাকি একা না; গত ২০ বছর ধরে প্রতিদিন ৩০ ক্যান কোকাকোলা গিলছেন এমন মানুষের খবরও এসেছে পত্রিকায়।
খবর প্রকাশিত হয়েছে এক কিশোরের যে টানা দুই বছর দুইবেলা বার্গার কিং খেয়েছে।
আবার সুপাররিচ গোত্রের কেউ কেউ লাক্সারী ব্র্যান্ড এবং ডিজাইনার ক্লথের প্রতি অ্যাডিক্টেড হয়; এমনকী চিকিৎসাও নেয়।
এ সবই ভোক্তার মনোজগতে ব্র্যান্ড অ্যাডিকশনের প্রমাণ।
*
ম্যাকডোনাল্ডস আসক্ত জ্যাক টাউনেন্ড |
ব্র্যান্ড অ্যাডিকশন ভালো না মন্দ?
ভোক্তার দিক থেকে চিন্তা করলে - মন্দ। এর খারাপ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসা নিতে হলে; ভালোর আর কী আছে?
বিক্রেতার দিক থেকে?
এক
হিসেবে হয়তো মনে হবে, ওদের জন্য ভালো। যদি এক লাখ এডিক্টেড কাস্টোমার
পাওয়া যায়, তাহলে তো লাভের উপরে লাভ। যা কিছু বাজারে আনা হবে, অ্যাডিক্টেড
কাস্টোমার সেটাই কিনবে।
তবে, এই অ্যাডিকশনের বিস্ফোরণ শেষ বিচারে ব্র্যান্ডের জন্য বুমেরাং হবে।
কোনো ব্র্যান্ডের ভোক্তারা অ্যাডিক্টেড হচ্ছে; এই ধারণা বাজারে প্রচারিত হলে - সচেতন ভোক্তারা ঐ ব্র্যান্ড থেকে নিজেকে দূরে রাখবে...
মাদকের কথাই ধরা যাক।
মাদক বিরোধী স্লোগানে - "মাদককে না বলুন" এবং শপথে শপথে "কোনোদিন মাদক ছোঁবো না" কি আমাদের কানে আসে না?
কোনো ব্র্যান্ড কি নিজেকে অস্পৃশ্য (অপবিত্র/অশুচি) হিসেবে দেখতে চাইবে?
তাই, ব্র্যান্ড অ্যাডিকশন কেবল ভোক্তার জন্য নয়, ব্র্যান্ড ম্যানেজারদের জন্যও ভাবনার (দুঃশ্চিন্তার) বিষয়।
ভেবে দেখুন, অজান্তেই আপনি কোনো ব্র্যান্ডের প্রতি অ্যাডিক্টেড হচ্ছেন না তো!
****
নোটঃ
এই
লেখা যখন শুরু করি, তখন অ্যাডিকশন ও ব্র্যান্ড অ্যাডিকশনের ফলে আচরণগত কী
কী পরিবর্তন ঘটে সেসবে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলাম। পরে দেখলাম, অ্যাকাডেমিক
জার্গনের প্রভাবে লেখাটি অনেকের জন্য অবোধ্য ও বিরক্তিকর হয় উঠবে। তাই
লেখাটিতে সরলীকরণের ভাব লক্ষণীয়। কেউ যদি ব্র্যান্ড অ্যাডিকশন নিয়ে
অ্যাকাডেমিক লেখা পড়তে চান, মেইলে জানাবেন।
No comments:
Post a Comment