আমরা কেন কিনি?

মরা কেন কিনি?
মোবাইলের কথাই ধরা যাক -
আমরা নতুন মোবাইল ফোন কেন কিনি?
উত্তরটা সহজ, যদি আপনার পুরনো ফোন নষ্ট হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়...
কিন্তু, ভেবে দেখুন - আপনার সর্বশেষ ২-৩টি ফোনের ইতিহাস কী বলে?
এমনকী হয়েছে যে, ফোনটি জাস্ট 'পুরনো হয়ে গেছে', তাই নতুন ফোন কিনেছেন?
পুরনো মানে কতো পুরনো হয়েছিল? ১ বছর, ২ বছর, নাকি ৩ বছর?

*
একটা কৌতুক মনে পড়লোঃ
প্রশ্নঃ একটা গাড়ি কখন পুরনো হয়?
উত্তরঃ যখন পাশের বাড়িতে একটা নতুন গাড়ি আসে।
*

মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও কি এমন হচ্ছে না?
এই যে অ্যাপল নতুন মোবাইল আনলো, এবার নাকি এক কিডনী বেচেও কেনা যাবে না, দুই কিডনী বেচতে হবে। চোখে জল আনা প্রাইস ট্যাগের অফার।
মানুষ কিন্তু কিনছে, এবং কিনবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এই দামী ফোন কিনছেন, তাদের সবার কি আগের ফোন নষ্ট হয়ে গেছে, নাকি 'পুরনো' হয়ে গেছে?

আমার পরিচিত কয়েকজন আইফোন ফ্যান মহা বিরক্ত। তাদের হাতের আইফোন এইট আর টেন বছর না ঘুরতেই 'পুরনো' হয়ে গেল!
আরেকজন দিব্যি এখনো আইফোন সিক্স চালাচ্ছে। তার বক্তব্য - আমার ফোন তো ঠিকই কাজ করছে, তাহলে নতুন ফোন নেবো কেন?

*
মাদের রিসার্চ টীমে যিনি টেকনোলজি ইনোভেশন নিয়ে কাজ করেন, তার হাতের স্যামসাং এস ফোর করুণ অবস্থায় টিকে আছে।

একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম - নতুন ফোন নাও না কেন?
আর সোজা উত্তরঃ এই সেট দিয়ে আমার কোন কাজটা করতে অসুবিধা হচ্ছে?
জিজ্ঞেস করলাম, পারফরম্যান্স কি পারফেক্ট?
জানালো, ব্যাটারি একটু মরে যাচ্ছে, কিন্তু অন-দ্য-গো তে সারাদিন চলে যায়।
সে যেহেতু ফোনে গেইম খেলে না, গান শোনে না, ছবি তোলে না তেমন, হোয়াটস্যাপ ইমেইল ল্যাপটপেই চালু থাকে - মোবাইল ফোনের উপর তার নির্ভরতা কম।
এই ফোন নষ্ট না হলে সে নতুন ফোন কিনবে না।
সে স্যামসাং ভক্ত।
তবে বছর বছর নিত্য নিত্যনতুন মডেল রিলিজ করা তার অপছন্দ।

এ প্রসঙ্গে সে এক গবেষণার কথা বললো - অপ্রয়োজনীয় গেজেটে মানুষের ঘরবাড়ি ভরে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এগুলো রিসাইকেল করা এক চ্যালেঞ্জ। পরিবেশও হুমকির মুখে।

*

বাংলাদেশে ওয়ালটন ব্র্যান্ডের মোবাইল মার্কেট এখন কেমন জানি না। ২০১৩-১৪ সালে তারা প্রতি মাসে নতুন নতুন "প্রিমো" রিলিজ করতো।
ওয়ালটনের ফেসবুক ওয়ালে এক বিরক্ত কাস্টমার লিখেছিল - মুরগির ডিম দেয়ার মতো করে ডেইলি ডেইলি নতুন মডেল ছাড়েন আপনারা। একটা ফোন কিনে শান্তি পাই না, দুইদিন পরেই নতুন মডেল দেখে আফসোস লাগে...
ক্ষোভের কারণটা বোঝা যায়।
ইদানিং সম্ভবতঃ শাওমি আর অপ্পোর বিরুদ্ধে একই অনুযোগ দেখতে পাচ্ছি।

*
যাক, কথা হচ্ছিল - হাতে থাকা মোবাইল সেট দিয়ে সব কাজ চললে, নতুন মডেল কেনা কতোটা দরকার?

কনজুমার বিহেইভিয়ার-এ আমরা দুই ধরনের ভ্যালুর কথা বলিঃ
ইউটিলিটারিয়ান ও হেডোনিক ভ্যালু।

ইউটিলিটারিয়ান মানে ফাংশনাল। কোনো কাজ ঠিক মতো সারা যাচ্ছে কিনা সেটা মূখ্য।
হেডোনিকের সাথে আবেগ জড়িত। মান মর্যাদা জড়িত।

ক্রেতারা প্রায়শই দুই রকম ভ্যালুর সম্মিলন ঘটাতে চান।


ছোট্ট উদাহরণ দিই -
আপনি হাতঘড়ি কিনবেন।
মূল উদ্দেশ্য সময় দেখা। এজন্য হয়তো ৫০০ টাকার মধ্যে চলনসই একটা ঘড়ি কিনতে পারেন।
অথচ খুব সম্ভাবনা আছে, এটা অনেকেই করবেন না। ভাববেন, ব্র্যান্ডেরড়ির দাম কেমন? দশ গুণ, মানে হাজার পাঁচেকে পাওয়া যাবে? তাহলে সেটাই কিনি...
এটাই ব্র্যান্ড ইক্যুইটি। নামের জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিচ্ছেন। হয়তো কোয়ালিটিও বেশি পাচ্ছেন। তাই দিচ্ছেন, ১০টা সাধারণ ঘড়ির দাম। কিংবা ১০০টা সাধারণ ঘড়ির দাম। ট্যাগ হয়্যার, আরো বেশিতে রাডো, রোলেক্স, ওমেগা?

হাতে ব্র্যান্ড থাকছে, এখানেই শেষ না। ব্র্যান্ডের দামি ঘড়ি পরে আপনি বেশ ফুর ফুরে বোধ করছেন, কেউ কেউ হয়তো বলছে, আরে খুব সুন্দর ঘড়ি তো। বাহ, ওয়াও "রোলেক্স"!

এভাবে আপনি একটা সেল্ফ গ্র্যাটিফিকেশন এবং সোশ্যাল এপ্রিশিয়েশন উপভোগ করেন। তাই ফেসবুকে ইনস্টাগ্রামে হাতের কফি কিংবা কলম গৌণ হয়ে যায়, কব্জিতে থাকা ঘড়িটি মুখ্য হয়ে ওঠে।

এই ইমোশনাল প্লেজারটাই হেডোনিক ভ্যালু।
*


দামী মোবাইল কেনার পেছনেও হেডোনিক ভ্যালু কাজ করে। সোশ্যাল স্ট্যাটাস আর পাবলিক সেল্ফ কনশাসনেসের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুইটা ফ্যাক্টর নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার আশা রাখছি।
আবার মোবাইল ফোনের প্রসঙ্গে যাই -
ধরি, যারা হাই এন্ড কাস্টমার না। ১৫-২৫ হাজার টাকার মধ্যে স্মার্টফোন কেনেন।
এরা কেন ঘন ঘন মডেল পাল্টান?
নতুন ফিচারের জন্য?
একটু 'বেটার' ক্যামেরা, নতুন ডিজাইন, ইন্টারন্যাল স্পেস - এগুলো কি খুব জরুরী? নাকি স্রেফ জোয়ারে গা ভাসানো?

থিয়রীতে ভ্যারাইটি সিকিং বিহেইভিয়ার বলে একটা কনসেপ্ট আছে, যার সারমর্ম হলো - ক্রেতারা নতুনত্ব চায়।

তাই মিড রেঞ্জের মোবাইল ফোন ইউজারদের ফোনও দ্রুত 'পুরনো' হয়ে যায়। কারণ, বাজারে বেটার/নতুন ফিচারের কিছু একটা এসে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। আমার সর্বশেষ ৬টি স্মার্টফোনের মাত্র ১টি নষ্ট হয়েছিল। বাকীগুলো 'পুরনো' হয়েছে। ব্যবহারকারী হিসেবে আমি ইউটিলিটারিয়ান জাতের হলেও ফোন বিষয়ে নতুনত্ব আমাকে আকৃষ্ট করে...
*


র্বশেষ যে আইফোনগুলো বাজারে এসেছে, এদের দাম দেখে অনেকের কান্না পায় অবস্থা। আগেই লিখেছি - এই মডেলগুলো লস খাবে না।
তবে এবার একটা নতুন ট্রেন্ড দেখা গেছে। কেবল দাম নিয়ে নয়, ফিচার নিয়েও ক্রেতারা প্রশ্ন তুলছে।
এসব ফিচার কি খুব জরুরী কিছু?
প্রাইস ফিচারের সমন্বয় হচ্ছে কি? নতুন মডেলের আইফোন কি খুব জরুরী?

এই প্রশ্নগুলো জরুরী।


দীর্ঘকালীন সাফল্যের জন্য সচেতন ভোক্তা সমাজ খুব জরুরী।

মুশকিল হলো - ক্যাপিটালিস্ট মার্কেটে এই সচেতনতার খুব অভাব।
বাজারের স্বার্থে, ব্র্যান্ডের স্বার্থে একটি সচেতন যৌক্তিক ভোক্তা সমাজ গড়ে ওঠা প্রয়োজন।


সেফাতুল্লাহ যখন বলেন "আমার টাকা দিয়ে আমি মদ খাই, তোদের কী?" তখন বেশ যৌক্তিক শোনায়। কিন্তু, মুক্ত বাজারে সেফাতুল্লাহ হয়তো ৫-৭টা ব্র্যান্ড এবং দাম যাচাই করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন।

কারণ, ওয়ালেটে ক্যাশ বা কার্ড থাকলে সারা দুনিয়া কেনা হয়তো যাবে।

কিন্তু সেই কেনার, সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় ব্রেইনের (চিন্তার এবং সচেতনতার) প্রভাব যেন তুচ্ছ না হয়।

No comments:

Post a Comment