ব্র্যান্ডের নাম বিষয়ক খুচরা আলাপ...




নামের বড়াই করো নাকো নাম দিয়ে হয়…
বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় গান যখন নামের মাঝে আসল পরিচয় না খোঁজার পরামর্শ দিচ্ছে – তখন ভেবে দেখুন আপনার নাম নিয়ে কতোটা খুশি আপনি! কখনো কি অন্য কোনো নামে নিজেকে প্রচার প্রসারের ইচ্ছা জেগেছে? অনেকের হয়তো এ আকাঙ্ক্ষা তীব্র। তাই ফেসবুকে নামের প্রথম কিংবা শেষ অংশের নিজেকে প্রিন্স-এঞ্জেল-কিউটি-হিরো-পাপী কিংবা ইনোসেন্ট করে নেয়াদের অভাব নেই।

বছর কয়েক আগে নাম নিয়ে মহাবিপদে পড়া Phuc Dat Bich –এর কথা মনে আছে নিশ্চয়!
শুনতে আপত্তিকর নামের জন্য ফেসবুক বারবার তাকে ব্লক করে দিচ্ছিলো। এই নিয়ে তার দেয়া পোস্ট শেয়ার হয়েছিল লক্ষাধিকবার।




বিশ্বের মেইনস্ট্রীম অনেক পত্রিকায় এই নাম বিভ্রাট নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল সে সময়। তবে বাজারে আলাপ আছে – পুরোটাই গুজব, বানোয়াট।

"সোনামনিদের সুন্দর নাম" বইটি এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। এখনো আছে হয়তো। সন্তানের নাম রাখা নিয়ে বাবা-মা-নানা-নানী-দাদা-দাদী-চাচা-মামা-খালা-ফুপু'দের চিন্তার সীমা নেই। 

জীবনের একটা পর্যায়ে এসে নাম পালটানো বেশ ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার। সেলিব্রিটিদের কথা অবশ্য আলাদা। হলিউড-বলিউড-ঢালিউড কিংবা টিভি পর্দার অনেক স্টারের নাম স্মৃতিবিস্তৃত। কেটি পেরি ছিলেন ক্যাথেরিন হডসন, অমিতাভ বচ্চন - ইনকিলাব শ্রীবাস্তব, বাংলা ব্যান্ডের জেমসের নাম ফারুখ মাহফুজ আনাম এখন কি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ? 

শিল্প সাহিত্যের নামকরণের সার্থকতা আছে, মানুষের নামকরণের সার্থকতা নেই। যেমন, শাহ আলম মানে দুনিয়ার বাদশা, কিন্তু দুনিয়ায় বহু শাহ আলম আছেন, যারা ভিক্ষা করেন।
  
ব্র্যান্ডের নামকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ!
কী নাম রাখবেন, কেন রাখবেন - কার সাথে আলাপ করবেন; সব দিক ভাবতে হয়।

একটি ব্র্যান্ডের জন্ম থেকে উত্থান এবং প্রচার প্রসার পর্যন্ত যতো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তার মাঝে নামকরণের সিদ্ধান্তকে বলা হচ্ছে সবচে’ কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

নাম হতে হবে, অন্যদের চেয়ে আলাদা। একটি শিশুর নাম যেমন পৃথিবীতে তার প্রথম পরিচয়, তেমনি ব্র্যান্ডের নামও প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে ফার্স্ট আইডেন্টিটি।

নাম রাখার পেছনে ব্র্যান্ডের স্রষ্টারা অনেক সময়-শ্রম-মেধা খরচ করেন। নিয়োগ করেন, কবি সাহিত্যিক থেকে শুরু করে নাম রাখার জন্য খ্যাত পেশাদারী সংস্থাকে।

বিশ্বের নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর ইতিহাসে নাম রাখার অধ্যায়টা খুব ইন্টারেস্টিং।
যেমন ধরুন, Amazon-এর নাম প্রথমে রাখা হচ্ছিল Cadabra.
অ্যাপলের নাম রাখার প্রস্তাবে পছন্দের তালিকায় ছিল Executech ও Matrix Electronics.
শুরুতে গুগলের নাম রাখা হয়েছিল Backrub.
তবে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ ও সার্গেই বিন দুজনেই খুব দ্রুত একমত হন যে ব্যাকরাব শুনতে কেমন যেন পর্ন সাইট – পর্ন সাইট মনে হয়।
টুইটারের নাম রাখার তালিকায় ছিল Throb, Vibrate, Tremble, Qickly ও FriendStalker.


নাম পাল্টানোর চর্চা খুব নতুন কিছু নয়।
বিদেশী ছবির মাঝে Pretty Woman এর প্রাথমিক নাম ছিল 3000.
জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস 1984 লেখার সময় নাম ছিল The last man in Europe.
হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘অয়োময়'-এর প্রাথমিক নাম ছিল ‘আমিন ডাক্তার'।

মান্না অভিনীত ‘জন্মদাতা’ ছবির নাম পালটে ‘কে আমার বাবা’ কেন রাখা হলো তার জবাব সম্ভবতঃ মনোয়ার হোসেন ডিপজল ও মনতাজুর রহমান আকবরই ভালো দিতে পারবেন। তবে অনুমান করা যায়, নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে ‘স্বামী কেন আসামী’র তুমুল সাফল্যের পরে সিনেমার নামে প্রশ্নবোধকের ব্যাপক জোয়ার এসেছিল। রাণী কেন ডাকাত, বাবা কেন চাকর, সন্তান কেন শত্রু, শান্ত কেন মাস্তান ইত্যাদি নাম স্মরণযোগ্য।

বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকাদের অধিকাংশই নাকি নিজের আকীকা দেয়া নাম বাদ নিয়ে নতুন নামে এফডিসিতে নাম লেখাতেন।

কিন্তু, নাম পাল্টালেই কি সব পালটায়?
দুই যুগ পেরিয়েও কি পিজি হাসপাতালের নাম মানুষের মন ও মুখ থেকে মুছে গেছে?
১০ বছর পরেও এখনো কি কেউ কেউ বলে ওঠেন না – “আমার একটেল নম্বরে ফোন দিও”।
ফারমার্স ব্যাংকের নাম মানুষের মন থেকে মুছে পদ্মা ব্যাংক হতে কত বছর লাগবে?


ব্র্যান্ডের প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
ভেবে দেখুন – নেটফ্লিক্সের প্রথম নাম ছিল Kibble।
কথিত আছে, বার্বি ডলের বার্বি ছিল মূলতঃ এক জার্মান প্রস্টিটিউট।
বিশ্বখ্যাত Swatch ঘড়ির নাম শুরুতে ছিল Vulgaris।

ওদিকে নাইকির নাম Fourth Dimension তো প্রায় কনফার্ম হয়েই যাচ্ছিল। কোম্পানীর ৪৮ জন কর্মচারীর ভোটের ফলাফলে চূড়ান্ত নাম নাইকি রাখা হয়। নাইকির লোগো ডিজাইন করে ক্যারোলিন ডেভিডসন পেয়েছিলেন মাত্র ৩৫ ডলার; সে গল্পও কারও অজানা নয়।




যার নাম নেই, তার অস্তিত্ব নেই।

এই নাম যেমন একদিকে Name, অন্যদিকে আবার Fame-ও হয়ে ওঠে। ফ্যামাসদের নাম যেমন (সাদ্দাম হোসেন, ইয়াসির আরাফাত) সমাদৃত, কিছু নাম আবার এতোই কুখ্যাত যে এই নামের মানুষ পাওয়াই এখন দূর্লভ (মীর জাফর, এরশাদ শিকদার)।

এখানে একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না –
এক পরিচিত মুদী দোকানীকে দেখলাম, সন্তানের নাম রেখেছে – মাশরাফি বিন মোর্তাজা।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম তো মোর্তাজা না, আপনার নাম আলমগীর। তাই বিনের পরে আলমগীর হবে। শুরুতে খানিকটা তর্ক করলেন।
পরে বিন সংক্রান্ত জটিলতা ধরতে পেরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "বিন তুলে দিয়ে শুধু মাশরাফি মোর্তাজা রাখলে সমস্যা আছে?"
বললাম, না – সমস্যা নেই।
"তাহলে নাম মাশরাফি মোর্তাজা থাকুক"।
তাকে মিস্টার বিন ও ওসামা বিন সংক্রান্ত জোকসটা বলা হয়নি। কারণ, সন্তানের নাম থেকে বিন তুলে দিয়ে তিনি আনন্দিত নাকি বিভ্রান্ত সেটা বুঝতে পারিনি।

ব্র্যান্ড এলিমেন্টের দিকে তাকালে আমরা দেখি সময়ের সাথে সাথে ব্র্যান্ডের লোগো, কালার, ডিজাইন, স্লোগান, প্যাকেজিং, দাম ইত্যাদি পরিবর্তন হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা হয়। কিন্তু, ব্র্যান্ডের নাম স্থায়ী থেকে যায়। এভাবেই ফোর্ড, পেপসি, হেইন্‌জ, শ্যানেল বয়সের বিচারে শতক পেরিয়ে এখন সেই চেনা ব্রাহ্মণ, যাকে চিনতে পৈতার প্রয়োজন খুব বেশি নেই।

তবে মাঝে মাঝে, বিশেষ করে মার্জার অ্যাকুইজিশনের ক্ষেত্রে, ব্র্যান্ডের নাম না পালটে উপায় থাকে না। তাই Ulay হয়েছে Olay.
চকলেট বার Marathon হয়েছে Snickers।
ম্যারাথন থেকে স্নিকার্সে নাম পাল্টানোর সময় কাস্টমারদের তীব্র অভিযোগ ছিল, কারণ স্নিকার্স নামের সঙ্গে উইমেন আন্ডারগার্মেন্টসের যোগসুত্র খুব স্পষ্ট ছিল।
স্নিকার্সের মালিক অনেক পরে স্বীকার করেন – স্নিকার্স ছিল আর রেসের ঘোড়ার নাম।
অবশ্য স্নিকার্স নিজের গুনেই কাস্টমারদের মন জয় করেছে; অনেকটা নামে নয় কাজে পরিচয়।

বেলজিয়ামের চকলেট ব্র্যান্ড Isis নাম পালটে Libeert হয়েছে ২০১৪ সালে। সন্ত্রাসী সংগঠনের সংগে নাম মিলে যাওয়ায় বেশ বেকায়দায় পড়েছিল এই ব্র্যান্ড।

নাম নিয়ে ফ্যানরা সব সময় হৈচৈ করবে তেমন কিন্তু না।
যেমন, আবাহনী ক্রীড়া চক্র পরে আবাহনী লিমিটেড হলো। ফ্যানদের কী এসে গেল?
ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর থেকে ঢাকা ডিনামাইট, পরে ঢাকা প্লাটুন হলেও; কিছু কি পাল্টালো?

তবে নামকেই পুঁজি করে গড়ে উঠেছে বিলিয়ন ডলারের কাউন্টারফিট মার্কেট।
বাজারে তাই নকল গ্যুচি, ল্যুই ভুটন, রোলেক্স, বারবেরি থেকে শুরু করে নকল বাটা, লাক্স, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ভরপুর।

বলা হয়, ব্র্যান্ডের নাম হতে হবে ছন্দময় ও কাব্যিক
(এ নিয়ে আলাদা বিস্তারিত পোস্ট আসবে আগামীতে)

এখানে সংক্ষেপে একটা নোট রাখি –
নাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত – যেসব ব্র্যান্ডের নামের উচ্চারণে ‘ক’ আসে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশিঃ কোকাকোলা, কোডাক, কেএফসি, ক্যাডবুরি, ক্যেলগস, কেলভিন ক্লেইন, কস্টা কফি, ক্যান্ডি ক্রাশ… তালিকা অনেক লম্বা।


ব্র্যান্ডের নামের ক্ষেত্রে কাব্যময়তায় ভায়াগ্রার নাম আসে আগে।
Viagara’র ‘Vi’ মূলতঃ Vitality, Vigour, Virility-কে ইংগিত করে।
অন্যদিকে ‘agra’ বলতে ‘catch’ বা ‘grasp’ বোঝায়।
ভায়াগ্রার সঙ্গে নায়াগ্রার সম্পর্ক আছে।
নায়াগ্রা ছিল উত্তর আমেরিকায় নববিবাহিতদের হানিমুনের উল্লেখযোগ্য স্পট। তবে, এ বিষয়টিকে ছাপিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের যে শক্তিমান স্রোত, তার সঙ্গে ভায়াগ্রার কার্যকারিতার দুষ্টু মিল আছে।

তাই চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের চন্দ্রিল যখন গেয়ে ওঠেন -
“তোমাকে দেখাবো নায়াগ্রা, তোমাকে শেখাবো ভায়াগ্রা
তোমাকে করবো আদর আত্তি যত্নম;
ওগো ত্বমসি মম জীবনম, ত্বমসি মম ভূষনম
ত্বমসি মম ভব জলধি রত্নম”
তখন, সেটা কেবল ছন্দময় লিরিক্স থাকে না, অন্তর্নিহিত অনেক অর্থ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।


অ্যাপল ব্র্যান্ড নেইম কি শুধুই আপেল?
যদিও শুরুর দিকে লোগোতে নিউটনের আপেলের ইংগিত ছিল।





বিশ্লেষকরা মনে করেন, আপেলের সঙ্গে ভোক্তাদের শৈশব স্মৃতি জড়িত। স্কুলের প্রথম দিনে অনেক দেশে শিশুরা শিক্ষকের জন্য একটি আপেল নিয়ে যেতো; সেই স্মৃতিকে উস্কে দেয় এই ব্র্যান্ড নেইম অ্যাপল। পুরাণের অ্যাডাম-ইভ আর স্বর্গের নিষিদ্ধ আপেলের কথা বলাই বাহুল্য।
 
স্টিভ জবস অবশ্য ম্যাকিনটোশের নাম প্রথমে অ্যাপল বাইসাইকেল রাখতে চেয়েছিলেন। আইম্যাকের প্রথম প্রস্তাবিত নাম ছিল ম্যাকম্যান। পরে এসব নাম বাতিল হয়ে গেছে।

তাত্ত্বিকভাবে ব্র্যান্ডের নাম ৩ রকম হতে পারে –
বিবরণমূলক (descriptive)
সাংকেতিক (allusive)
নতুন উদ্ভাবন (coined)

বিবরণমূলক – এক্ষেত্রে একেবারে সোজাসাপ্টা বলে দেয়া হয় এই ব্র্যান্ড কী, এই ব্র্যান্ড কী করে। যেমন – স্টার কাবাব, মামা হালিম, বার্গার কিং, গ্রামীণ ফোন, চালডাল ডট কম, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, কিংবা বিডিজবস ডট কম।

সাংকেতিক – এরকম নাম কিছুটা পরোক্ষভাবে ধারণা দেয়; এই ব্র্যান্ডের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী? প্রথম আলো কোনো মোমবাতি বা বাল্ব কোম্পানি না। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সব সংবাদ পাঠকের দ্বারে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই নাম। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ব্যাখ্যা দেয় – নর্থ অ্যামেরিকান এডুকেশন ইন সাউথ এশিয়ান সেটিং। ভিসা কার্ড যেমন খুলে দেয় ভোগের দরজা। ফ্যান্টাসী কিংডম কিংবা বাবুল্যান্ডের নামকরণেও সাংকেতিক ব্যাপার আছে।

নতুন উদ্ভাবন – এটা মূলতঃ একেবারে নতুন শব্দ নিয়ে আসা। কোডাকের নামকরণ একেবারে নতুন শব্দ আবিষ্কারের মাধ্যমেই হয়েছে। মাস্টারমাইন্ডের ভাবনায় ‘ক’ উচ্চারণের প্রভাবের ব্যাপারটি হয়তো ছিল। নাম রাখার জন্য বিশ্বের অন্যতম পেশাদারী সংস্থা - লেক্সিকন। এরাই পেন্টিয়াম নামের স্রষ্টা। গ্রীক ভাষায় Pente মানে পাঁচ, আর ium  এসেছে কেমেস্ট্রির পিরিয়ডিক টেবিল থেকে; উপাদান (element) নির্দেশ করে। তবে, পেন্টিয়ামের নামকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে ইন্টেলের হর্তাকর্তারা তেমন খুশি ছিলো না। কেউ কেউ বলেছে – পেন্টিয়াম শুনলে টুথপেস্টের ব্র্যান্ড মনে হয়। আর কেউ বলেছে, এটা শুনলে মনে হয় আফ্রিকার গহীন অরণ্যে পাওয়া দুর্লভ কোনো রত্নের নাম। আরেকজন অবশ্য এমনও বলেছে যে, পেন্টিয়াম হতে পারে জেমস বন্ডের পরবর্তী সিনেমার নাম!

নতুন শব্দ উদ্ভাবনের মাধ্যমে নাম রাখা খুব জনপ্রিয় ঔষধ কোম্পানীর ক্ষেত্রে। ঘুমের ঔষধের নাম হিসেবে ZzzQuil খুব চমৎকার।

ওজন কমানোর ঔষধের নাম Obenil. মানে ওবেসিটিকে নিল করে দেবে!

ওপরে যে ৩ রকম ব্র্যান্ডের নামের কথা বললাম, সেটা কোনো চিরস্থায়ী পদ্ধতি নয়। অন্য অনেক রকমভাবে ব্র্যান্ডের নাম রাখা যায় –


মানুষের নামে নাম (People)
বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডের অধিকাংশ নাম মানুষের নামে। ডিজনী, ম্যাকডোনাল্ডস, ক্যেলগ্‌স, হেইনিকেইন, হেইন্‌জ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, হারলে-ডেভিডসন, প্রক্টর অ্যাণ্ড গ্যাম্বল, ল’রিয়েল, ফাইজার…। ব্র্যান্ডের স্রষ্টার নামেও নাম হয় – শ্যানেল, গ্যুচি, প্রাডা, ল্যুই ভুটন, টমি হিলফিগার, ফোর্ড; এরকম অসংখ্য।

বাংলাদেশের আলমের এক নম্বর পঁচা সাবান, নান্না বিরিয়ানী, মোস্তাকিমের চাপ, বিউটি লাচ্ছি, সোহাগ পরিবহন, হাকিমপুরী জর্দা কিংবা মরণচাঁদ মিষ্টির কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

আশির দশকে এক ব্যবসায়ী একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে বিনিয়োগ করেছিলেন; নিজের স্ত্রী ঝরণার নামে পত্রিকার নাম রেখেছিলেন “সাপ্তাহিক ঝরণা”।

তবে আইন পেশা, ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম, বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতার নামে নামকরণ খুব প্রচলিত।


স্থানের নামে নাম (Place)
এটা খুব সহজ এবং সরল পদ্ধতি। এলাকাভিত্তিক বা স্থানীয়করণের অনুভূতি নিয়ে ব্র্যান্ডের নাম হতে পারে কোনো জায়গার নামে। যেমন, ঢাকা ম্যাচ, বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার, মেক্কা কোলা, দৈনিক শীতলক্ষ্যা, রোহিতপুরী লুঙ্গি, কর্ণফুলি ফার্টিলাইজার বা মহানন্দা রেডিও। নদীর নামে নাম হয়েছে নোকিয়ার। আল্পসের সর্বোচ্চ পর্বতের নামে Mont Blanc-এর নাম হয়েছে। বাস্তবে Franklin নামের পর্বতের অস্তিত্ব না থাকলেও, কোকা-কোলার পানীয় মাউন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন পান করে অনেকে আগ্রহী হয়ে জানতে চায় - অস্ট্রেলিয়ার কোথায় আছে মাউন্ট ফ্রাঙ্কলিন। সুদূরের মিল্কিওয়ের নামে হয়েছে চকলেট বার।





পণ্যের নামে নাম (Product)
সুনির্দিষ্ট পণ্যটির নামেও ব্র্যান্ডের নাম হতে পারে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, অ্যামেরিকান অ্যাপারেল, অস্ট্রেলিয়ান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন, টয়’স আর আস, ডাঙ্কিন’ ডোনাট, পিসি ওয়ার্ল্ড, সানগ্লাস হাট, হোটেল ডট কম, এয়ারবাস, প্লে স্টেশন, হলিডে ইন, ফুট লকার, সোফা ডট কম, রায়ান কম্পিউটার্স, জনি প্রিন্ট শাড়ি, এপেক্স স্যুজ, শাহ সিমেন্ট, নাসির গ্লাস; এই ক্যাটেগরির উদাহরণ।


মূল নামের সংক্ষিপ্তরূপ (Pact)
কিছু ব্র্যান্ডের নামে একাধিক শব্দ থাকে। ফলে, উচ্চারণ এবং মনে রাখার জটিলতা তৈরি হয়। এ ব্র্যান্ডগুলো সংক্ষিপ্তরূপেই বেশি পরিচিত। যেমন, BBC, HSBC, FIAT, IKEA, HP, BMW, IBM, MTV, HBO, BRAC, ASA, NABISCO ইত্যাদি। KFC শুরুতে পুরো নাম কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেনই ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে ফ্রায়েড চিকেনের অস্বাস্থ্যকর দিক বিবেচনা করে নাম সংক্ষেপে কেএফসি করেছে।


নামের সঙ্গে সংখ্যা (Quant)
ব্র্যান্ডের নামে সংখ্যার সংযুক্তি খুব প্রচলিত। যেমন - CK1, Jet2, VO5, EA7, Oxy10, WD40, Xbox 360, Airbus 380, Boeing 575, PS5, কিংবা তিব্বত ৫৭০। এই তালিকা আরো লম্বা হতে পারে –
ফার্স্ট সিক্যুরিটি ইসলামি ব্যাংক
সেকেন্ড কাপ (কফি)
তৃতীয় মাত্রা (টিভি টক শো)
ফোর সিজনস (লাক্সারি হোটেল)
পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট, সিলেট
সিক্স স্টার ফার্নিচার, সাভার
সেভেন হর্স সিমেন্ট
এইট ও’ক্লক কফি
চ্যনেল নাইন - ইত্যাদি।


বুদ্ধিদীপ্ত – হাস্যরসাত্মক নাম
এটা অনেক সময় ব্র্যান্ডের নাম ও স্লোগানের সঙ্গে মিলে মিশে থাকে। যেমন
Curl up and Dye (সেলুন)
Wok this way (ওরিয়েন্টাল রেস্টুরেন্ট)
Doggy style (পোষা কুকুরের সেলুন - প্রসাধন)
Knobs & Knockers (দরজা ও দরজার যন্ত্রপাতি)
Planets of the tapes (ভিডিও রেন্টাল)
Pick & Pay (সুপার শপ)

সুচিত্রা সেলুন-এর সাইনবোর্ডে লেখা ছিল - এখানে উত্তমরূপে চুল কাটা হয়


বিখ্যাত বই এবং নাটক সিনেমার চরিত্র থেকেও ব্র্যান্ডের নামকরণ হয়
Starbucks (Mobi-Dick)
Yahoo (Gulliver’s Travels)
Ariel (The Tempest)
Ivory Soap (Holy Bible)

নামকরণের আরেক প্রচলিত উপায় হলো কপিক্যাট – সেটা কাপড় কাচার সাবানের নাম ইউনিলিভারের ‘হুইল’ অনুসরণে স্কয়ারের ‘চাকা’ হতে পারে। আবার Coca-cola’র কপিক্যাট Co Kola, Coke-Ola, Okla-Cola, Sola-Cola, Klu-Cola হতে পারে।

নাম থেকে e বাদ দেয়া এবং x যোগ করার প্রচলনও দেখা গেছে – Tumblr, Flickr, Xbox, SpaceX..
ইংরেজী হরফের আপার কেইস লোয়ার কেইসের মিশ্রণও উল্লেখ করার মতো – PlayStation, YouTube.

ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে ব্র্যান্ডের নামের ভাষান্তরও খুব স্বাভাবিক চর্চা। বিশেষ করে চীনে অ্যাডিডাস, ফক্সভাগেনসহ অনেক ব্র্যান্ড নাম পাল্টিয়েছে।

যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোক না কেন, ব্র্যান্ডের নামকরণের পেছনে প্রচুর ব্রেইনওয়ার্ক আর গবেষণার প্রয়োজন। নয়তো আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ব্র্যান্ডের মৃত্যুর সম্ভাবনাও তৈরি হয়।


ভুল নামকরণের প্রায়শ্চিত্তের ভালো উদাহরণ হতে পারে ফোর্ড মোটরসের প্রথম দিকের নাম Edsel. ১৯৫৬-১৯৫৯ সালে এই ভুল নামের কারণে, ফোর্ডের মোট ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৫০ মিলিয়ন ডলার। এই লেখাটি অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে, তাই Edsel কাহিনি ব্র্যান্ডের নাম বিষয়ক পরবর্তী লেখার জন্য তুলে রাখলাম।




2 comments:

  1. ভাল লাগলো,ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. হুম খুম সুন্দর আলোচনা

    ReplyDelete