“১২ মাসের বেশি সময় ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা অ্যাকাউন্টগুলো বাতিল করা হবে। যারা আমাদের সেবা নিচ্ছে না, তাদের থেকে অহেতুক মাসে মাসে বিল কেন নেব? আমাদের এ সিদ্ধান্তের কারণে কিছু লোকের কষ্টার্জিত অর্থ সাশ্রয় হবে”
২০২০ সালের মে মাসে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম নেটফ্লিক্স এ ঘোষণা দিয়েছিল।
ভোক্তার এমন মঙ্গলের কথা কোন ব্র্যান্ড ভেবেছে কোন কালে?
এ ঘোষণার বছর দেড়েক আগেই নেটফ্লিক্স তাদের চার ক্যাটেগরির প্রত্যেকটির সাবস্ক্রিপশনের ফি বাড়িয়েছে ১৩-১৮ শতাংশের মতো। দাম বাড়ানোর পরেও নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার বেড়েছে ৪০ মিলিয়ন। স্টক মার্কেটে প্রতিটি শেয়ারের দাম ৩৫০ ডলার থেকে বেড়ে ৪২৯ ডলার হয়েছে।
নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্টগুলো বাতিল করে ভোক্তা-বান্ধব ব্র্যান্ডের ইমেজ যখন নেটফ্লিক্স দাঁড় করাতে চাচ্ছে তখন ভিডিও স্ট্রিমিং ইন্ডাস্ট্রির ভেতরকার অবস্থা বেশ গরমাগরম। নতুন নতুন কোম্পানী বাজারে এসেছে; দামের দিক থেকে একে অন্যের ঘাঁড়ের ওপরে নিঃশ্বাস ফেলছে; বিশেষজ্ঞরা বলছেন - “স্ট্রিমিং ওয়ার” শুরু হয়ে গেছে। শীতল যুদ্ধের শুরুতে নেটফ্লিক্স ইতোমধ্যে তাদের বেশ কিছু “সবচে’ বেশি দেখা” কন্টেন্ট ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে জনপ্রিয় টিভি সিরিজ এবং সিনেমাগুলোর দাম একদিকে যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে অরিজিনাল কন্টেন্ট প্রোডাকশনের জন্য প্রয়োজন হয়েছে বড়সড় আর্থিক বিনিয়োগ।
২০১৩ সালের পর থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত নেটফ্লিক্স তাদের সাবস্ক্রিপশন ফি বাড়িয়েছে চারবার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমবর্ধমান সাবস্ক্রিপশন দেখে অনেকেই বলছেন – নেটফ্লিক্সের উচিত এখন আরেক দফা দাম বাড়ানো। বাড়তি আয় এবং মুনাফা দিয়ে নেটফ্লিক্স তার পাহাড়সম খরচ সামাল দিয়ে বাড়তি বিনিয়োগে মন দিতে পারবে। অবশ্য এমন ঝুঁকিও আছে যে বাড়তি দামের ধাক্কায় কাস্টমাররা সুইচ করে অন্যদিকে চলে যাবে।
ডিজিটাল এন্টারটেইনমেন্টের এই স্ট্রিমিং যুদ্ধে নেটফ্লিক্স কি আবার দাম বাড়াবে?
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে এ লেখায়। নেটফ্লিক্সের অতীত-বর্তমান জানার পাশাপাশি উঠে আসবে স্ট্রিমিং ইন্ডাস্ট্রির টুকিটাকি।
নেটফ্লিক্সের যাত্রা
শুরুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কট ভ্যালি শহরে, ১৯৯৭ সালের ২৯ আগস্টে।
প্রতিষ্ঠাতা রীড হ্যাস্টিংস এবং মার্ক রেন্ডলফ।
শুরুতে নেটফ্লিক্স ডিভিডি ভাড়া দিতো ও বিক্রি করতো; সরাসরি কাস্টমারের ঠিকানায় ডিভিডি পৌঁছে যেতো। যাত্রা শুরুর দু’বছরের মাথায় ১৯৯৯ সালে হ্যাস্টিংস নেটফ্লিক্সের সিইও হন। অন্যদিকে রেন্ডলফ নেটফ্লিক্স ছেড়ে চলে যান ২০০৩ সালে।
সে সময় মানুষের ঘরে-বসে-দেখার বিনোদন উপভোগের সুযোগ ছিল সীমিত। হয়তো কিছু ফ্রি টিভি চ্যানেল, সঙ্গে ক্যাবল টিভি, আর ভাড়া করে আনা ভিসিডি – ডিভিডি।
এসব ভিসিডি – ডিভিডির ব্যবসাগুলো দোকান ভাড়া করে চলতো মহল্লার মোড়ে মোড়ে। কাস্টমাররা ভিসিডি-ডিভিডি ভাড়া করতো সুনির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য, নির্ধারিত সময়ে ফেরত দিতে না পারলে জরিমানা হিসেবে বিলম্ব ফি দেয়া লাগতো। মাঝে মাঝে দেখা যেতো একটা ডিভিডির মূল ভাড়ার চেয়ে জরিমানার পরিমাণ হয়ে গেছে কয়েকগুণ বেশি।
যেমন, একটা হিসাব বলছে – ২০০০ সালে রেন্টাল চেইন ব্র্যান্ড ‘ব্লকবাস্টার’ কেবল বিলম্ব ফি-ই আদায় করেছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার। ইট কাঠের দোকানে বসে ডিভিডি রেন্টাল ব্যবসার বেশ কিছু সমস্যা ছিল। যেমন, দোকানের তাকের ধারণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে অগুণতি ডিভিডি রাখার সুযোগ ছিল না। আবার নতুন এবং জনপ্রিয় শো-সিনেমার ডিভিডিগুলো প্রায়ই স্টকে থাকতো না। চাহিদা-যোগানের সমন্বয় হতো না।
নেটফ্লিক্সের শুরুর দিকের গ্রাহক ফি ছিল ভিডিও রেন্টাল দোকানগুলোর কাছাকাছি।
৭ দিনের জন্য প্রতিটি ডিভিডি ভাড়া ৪ ডলার + শিপিং ফি ২ ডলার; সঙ্গে বিলম্ব ফি তো ছিলোই। প্রথম বছরের লেনদেন খুব সুখকর কিছু ছিল না। তেমন কাস্টমার পায়নি নেটফ্লিক্স।
এরপর নেটফ্লিক্স তার বিজনেস মডেল পালটায়। খুচরা ডিভিডি ভাড়া (পে-পার-রেন্টাল) থেকে সাবস্ক্রিপশন সিস্টেমে নিজেদের নিয়ে যায়; বিলম্ব ফি তুলে দেয়া হলো। একসঙ্গে ৩টি ডিভিডি ভাড়া নেয়া যাবে। এগুলো ফেরত দিলেই নতুন ডিভিডি পাবে; এভাবে।
ফি?
আনলিমিটেড রেন্টাল – মাসে ১৯.৯৫ ডলার। অবশ্য তিনটির জায়গায় একটি বা দু’টি ডিভিডি নেয়ার সুলভ প্যাকেজও ছিল।
বিজনেস মডেলে এ পরিবর্তন বেশ কাজে আসলো। কাস্টমারদের নজর কাড়লো নেটফ্লিক্স। ম্যুভি স্টুডিওগুলোর সঙ্গে রেভিনিউ-শেয়ারিং-অ্যাগ্রিমেন্টে গিয়ে আর্থিক ও ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেলো নেটফ্লিক্স।
২০০২ সালে এসে নেটফ্লিক্সের সংগ্রহশালায় টিভি শো, ম্যুভি, ডকুমেন্টারির সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজারের কাছাকাছি। নেটফ্লিক্সের ওয়েব সাইটে সব নামের তালিকা প্রকাশ করা হলো। লোকজন সেখান থেকে পছন্দ মতো ডিভিডি সিলেক্ট করছে, আর নেটফ্লিক্সের ২৫টি ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারের মাধ্যমে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের কাছে ডিভিডি পৌঁছে যাচ্ছে।
এলো সিনেম্যাচ
ওয়েব সাইটে ভোক্তাদের রুচি পছন্দ অনুযায়ী শো সাজেস্ট করার জন্য নেটফ্লিক্সের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররা সিনেম্যাচ চালু করলো। এই এলগরিদমের কাজ ছিল একজন ইউজারের ম্যুভি রিভিউর ওপর ভিত্তি করে তাকে সে মাফিক অন্য ম্যুভি রেকমেন্ড করা।
সিনেম্যাচের কল্যাণে নতুন যে সুযোগ নেটফ্লিক্সের সামনে খুলে গেল তা হলো – অনেক দর্শক পুরনো এবং কম জনপ্রিয় সিনেমা দেখতে আগ্রহী। ভোক্তার চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে নেটফ্লিক্স অনেক পুরনো ম্যুভি তালিকাভুক্ত করলো; এসব ম্যুভির লাইসেন্স কেনার খরচও তুলনামূলকভাবে কম। উল্লেখ্য, সে সময় “ব্লকব্লাস্টার”সহ অন্যান্য রেন্টাল চেইনগুলো কেবল নতুন এবং জনপ্রিয় সিনেমাগুলো নিয়ে ব্যবসা করছিল। সিনেম্যাচের কল্যাণে নেটফ্লিক্স এ জায়গায় বেশ এগিয়ে গেল। সে সময় নেটফ্লিক্সের প্রায় ৭০% ডিভিডি রেন্টাল হচ্ছিল সিনেম্যাচের রেকমেন্ডশন থেকে…।
নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বাড়ছে – ঠিক এমন সময়, ২০০৪ সালের জুনে, নেটফ্লিক্স তাদের সাবস্ক্রিপশন ফি ১৯.৯৫ থেকে বাড়িয়ে ২১.৯৯ ডলার করে।
নেটফ্লিক্সের বিজনেস মডেল অনুসরণ করে সে সময় ব্লকবাস্টারও অনলাইন মেইল-রেন্টাল প্ল্যাটফরম চালু করে; মাসে বিল ১৯.৯৯, কোনো বিলম্ব ফি নেই। প্রতিযোগিতা কেবল নেটফ্লিক্স আর ব্লকবাস্টারের মধ্যে সীমিত থাকলো না। সঙ্গে যোগ দিলো ওয়াল-মার্ট ডিভিডি রেন্টালস এবং রেডবক্স; এ দুই কোম্পানীর ফি নেটফ্লিক্স এবং ব্লকব্লাস্টার থেকে খানিকটা কমই ছিল।
অক্টোবর, ২০০৪।
চতুর্মূখী প্রতিযোগিতায় কিছুটা সুবিধা পেতে নেটফ্লিক্স দাম কমালো; ২১.৯৯ ডলার থেকে কমিয়ে ১৭.৯৯ ডলার।
দেখাদেখি ব্লকব্লাস্টারও তাদের দাম কমিয়ে ১৯.৪৯ করলো।
ওয়াল-মার্ট ডিভিডি রেন্টাল চুপ থাকবে কেন? তারা বিল নামিয়ে আনলো ১৭.৩৬ ডলারে।
২০০৪ শেষটা ভিডিও রেন্টাল ইন্ডাস্ট্রি দাম-যুদ্ধে ঘর্মাক্ত হলো।
তবে যুদ্ধের শেষ হলো না।
নতুন বছরের শুরুতে ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ব্লকবাস্টার তাদের নাম আরও কমালো – ১৪.৯৯ ডলার।
প্রতিক্রিয়ায় নেটফ্লিক্সও ১৪.৯৯ ডলারে নামলো; একসঙ্গে দুটো ডিভিডি নেয়া যাবে।
তবে একটা ব্যাপারে চার প্রতিযোগী একমত হলো – এভাবে দাম কমানোর টম অ্যান্ড জেরী খেলে ব্যবসা করা যাবে না; কনটেন্টের দিকে মন দিতে হবে।
পরের বছর, ২০০৫ সালের মার্চে, নেটফ্লিক্সের তালিকায় ছিল ৪০ হাজার ভিডিও টাইটেল।
ব্লকব্লাস্টারের ৩৫ হাজার, ওয়াল-মার্টের ১৬ হাজার।
খুব সম্ভবত কম কন্টেন্টের কারণে ওয়াল-মার্ট তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। ২০০৫ সালের মে মাসে ওয়াল-মার্ট ডিভিডি রেন্টাল বিজনেস গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বিদায় বেলায় কাস্টমারদের নেটফ্লিক্সের সেবা নিতে পরামর্শ দিলো ওয়াল-মার্ট। এমনই অসহায় আত্মসমর্পন!
ওয়াল-মার্ট বিদায় নিলেও, নেটফ্লিক্স এবং ব্লকবাস্টারের মাঝে দাম-যুদ্ধ ২০০৫-০৬ সালেও কমেনি।
নেটফ্লিক্সের ম্যুভি লিস্ট লম্বা থেকে লম্বা হচ্ছিল নিয়মিত। মাসে ৬ ডলার ও ১০ ডলারের সাশ্রয়ী প্যাকেজ নিয়ে এলো নেটফ্লিক্স।
২০০৬ সালের শেষে নেটফ্লিক্সের আয় দাঁড়ায় ১ বিলিয়ন ডলার। সাবস্ক্রাইবার ৬৩ লাখ।
এর পরের বছরগুলোয় নেটফ্লিক্স যখন তরতর করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, ব্লকব্লাস্টারের অবস্থা পুরো উলটো। কাস্টমারের সংখ্যা কমছে, আয় কমছে, লাভ কমছে। অবশেষে ২০১০ সালে নয় হাজারের বেশি দোকান বন্ধ করে দিয়ে ব্যবসা গুটানোর আগে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে ব্লকব্লাস্টার।
অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের জগতে পা রাখে নেটফ্লিক্স।
এ সময় ইন্টারনেটও সুলভ এবং সহজলভ্য হচ্ছিল চারদিকে।
শুরুতে অবশ্য নেটফ্লিক্সের কাস্টমারদের কাছে অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস ফ্রি ছিল সীমিত পরিসরে। যেমন, যারা মাসে ১৮ ডলারের প্যাকেজ নিয়েছিল তারা মাসে ১৮ ঘন্টা ফ্রি স্ট্রিমিং দেখতে পেতো। অনলাইন স্ট্রিমিং এক নতুন দিনের নতুন সম্ভাবনার সুযোগ নিয়ে এলেও তখনো নেটফ্লিক্সের মূল নজর ছিল ডিভিডি রেন্টালের দিকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বছরান্তে নেটফ্লিক্সের দাম কমলো আরো এক ডলার।
নেটফ্লিক্সের অনলাইন উপস্থিতিকে অনুসরণ করে তখন বাজারে সক্রিয় সিনেমানাউ, মাইক্রোসফট যিউন এবং অ্যামাজন আনবক্স (এখন যার নাম অ্যামাজন প্রাইম)। এসব কোম্পানী অবশ্য অনলাইনে স্ট্রিমিং করতো না। ম্যুভি ডাউনলোড করে দেখতে হতো। অনলাইনে ম্যুভির সংখ্যাও কম ছিল। আরও সীমাবদ্ধতা ছিল।
যেমন, অ্যামাজন আনবক্স কেবল এমএস উইন্ডোজ ব্যবহার করে দেখা যেতো।
নেটফ্লিক্স দেখা যেতো শুধু ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারে।
এর বাইরে ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে নিম্নমানের ভিডিও রেজ্যুলেশনও আরেক জটিলতা হয়ে দেখা দেয়।
এত সমস্যা মাথায় নিয়েও নেটফ্লিক্স অনলাইন স্ট্রিমিং চালু রাখে। মনোযোগ দেয়, কনটেন্ট লাইব্রেরির দিকে। বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থা থেকে নাটক, সিনেমা, ডকুমেন্টারি লাইসেন্স কিনে নেয়। বাড়তে থাকে অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিসের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা।
বাজারে চাহিদা যেহেতু আছে, যোগানও বাড়লো।
২০০৮ সালের দিকে অনলাইন স্ট্রিমিংয়ে পা রাখলো এনবিসি ইউনিভার্সেলের হুলু। এবিসি, সিবিএস এবং সিডব্লিউর মতো টিভি নেটওয়ার্কগুলো সীমিত আকারে ফ্রি অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ করে দিলো। তবে অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন বিরতি থাকতো।
দর্শকরাও অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের নতুন নেশায়।
যারা নেটফ্লিক্সের ডিভিডি রেন্টালের সবচে’ দামী তিনটি প্যাকেজের গ্রাহক ছিল, তারা আনলিমিটেড স্ট্রিমিং দেখার সুযোগ পেল। সবচে’ সস্তা প্যাকেজের গ্রাহকরা, মাসে ৫ ডলার দিতো, তারাও মাসে ২ ঘন্টা ফ্রি স্ট্রিমিং পেলো। নেটফ্লিক্সের স্ট্রিমিং লাইব্রেরির কনটেন্ট সংখ্যায় ১৫ হাজার হলো ২০০৮ সালের অক্টোবরে।
প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, এবং নতুন প্ল্যান
২০০৮ সালেই সিলিকন ভ্যালির স্টার্ট আপ ফার্ম রুকো’র সঙ্গে মিলে নতুন এক ডিভাইস উদ্ভাবন করেছিল নেটফ্লিক্স। এ ডিভাইসের সাহায্যে দর্শকরা টিভিতে নেটফ্লিক্স দেখতে পেতো। পরের দু’ বছরে তথ্য প্রযুক্তি ব্যাপক উন্নয়ন, উদ্ভাবন আর অভিনবত্বের কারণে বিভিন্ন ধরণের ডিভাইসে নেটফ্লিক্স দেখার সুযোগ এলো। সঙ্গে যুক্ত হলো দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা। নিজেদের আরেক উচ্চতায় নেয়ার সুযোগ পেলো নেটফ্লিক্স।
নভেম্বর ২০১০।
গ্রাহকদের জন্য আলাদাভাবে শুধু স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু করলো নেটফ্লিক্স; মাসে বিল ৭.৯৯ ডলার। যুগপৎ দু’টি ডিভাইস থেকে হাই ডেফিনিশন ভিডিও দেখা যেতো।
প্রতিষ্ঠাতা রীড হ্যাস্টিংস ঘোষণা করলো, “আমরা এখন মূলতঃ একটা অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং কোম্পানি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন টিভি শো এবং সিনেমা দর্শকদের মাঝে সরবরাহ করি”। নতুন আরেক ঘোষণায় ডিভিডি রেন্টালের দাম ১-৩ ডলার করে বাড়িয়ে দেয়া হলো। উল্লেখ্য, ডিভিডি রেন্টালের গ্রাহকরা বাড়তি হিসেবে অনলাইন স্ট্রিমিং পাচ্ছিল ফ্রি।
নেটফ্লিক্স যেনো এক সত্যিকারের লিডার।
সব সময় অন্যকে পথ দেখিয়ে দেয়। সে দেখানো পথে অনলাইন স্ট্রিমিংয়ে আরও সক্রিয় হলো হুলু। বিজ্ঞাপন বিরতিওয়ালা ফ্রি সার্ভিসের পাশাপাশি তারা ২০১০ সালে নিয়ে এলো হুলো প্লাস।
২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা অ্যামাজন আনবক্স খুব বেশি সাফল্যের মুখ না দেখলেও, ২০১১ সালে ৯০ হাজার ভিডিও টাইটেল নিয়ে অনলাইন স্ট্রিমিংয়ে নতুন মাত্রা আনে অ্যামাজন ইনস্ট্যান্ট ভিডিও। শক্তপোক্ত অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফরমের কারণে অ্যামাজনের কিছুটা সুবিধাই ছিল। বিশেষ করে অ্যামাজন প্রাইমের গ্রাহকরা প্রায় ৫ হাজার ভিডিওতে ফ্রি এক্সেস পেয়েছিল, সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের জন্য ফ্রি শিপিং, ডিসকাউন্ট অফারও ছিল।
কুইকস্টার
– সিদ্ধান্ত কি ঠিক ছিল?
২০১১ সালের মাঝামাঝি এসে নেটফ্লিক্স বুঝতে পারে গ্রাহকরা ডিভিডি রেন্টালের চেয়ে অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের দিকে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন গ্রাহকদের অধিকাংশই ছিল অনলাইন স্ট্রিমিং ক্যাটেগরির। ফলে, নেটফ্লিক্সকে মনোযোগ দিতে হলো কীভাবে অনলাইন কন্টেন্ট আরো সমৃদ্ধ করা যায়, কীভাবে আরও নতুন নতুন নাটক সিনেমা লাইব্রেরিতে যোগ করা যায়। এর ফায়দা নিলো নাটক সিনেমার প্রযোজক সংস্থাগুলো; লাইসেন্সিংয়ের দাম বাড়িয়ে দিলো। চাপে পড়লো নেটফ্লিক্স। ২০১০ সালে নেটফ্লিক্স লাইসেন্সিং ফি দিয়েছিল ১৮০ মিলিয়ন ডলার, যেটা ২০১২ সালে ২ বিলিয়ন ডলার হবে বলে অনুমান করা হচ্ছিল সে সময়।
এ আর্থিক ধাক্কা সামাল দিতে নেটফ্লিক্স তার সাবস্ক্রিপশন ফি পদ্ধতির আমুল পরিবর্তনের ঘোষণা দেয়।
২০১১ সালের জুলাই মাসে নেটফ্লিক্স ঘোষণা দিলো, ডিভিডি রেন্টালের গ্রাহকরা আর ফ্রি স্ট্রিমিং দেখতে পাবে না। ডিভিডি রেন্টাল আর স্ট্রিমিং হবে পুরোপুরি সার্ভিস। দুটো আলাদা আলাদা করে সাবস্ক্রাইব করতে হবে।
এমন ঘোষণা চারপাশে শোরগোল শুরু করলো। কারণ, সে সময় নেটফ্লিক্সের ৫৭% গ্রাহক ছিল ডিভিডি রেন্টালের, বাকী ৪৩% অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের।
গ্রাহকদের দিক থেকেও তিক্ত প্রতিক্রিয়া এলো। নেটফ্লিক্সের এমন সিদ্ধান্তকে অগ্রহণযোগ্য এবং অপেশাদার বলার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাতা রীড হ্যাস্টিংসকে লোভী বলে ধিক্কার উঠলো সোশ্যাল মিডিয়ায়।
এরমাঝে ঘটলো আরেক বিপত্তি।
যে স্টারজ কোম্পানি থেকে বছরে ৩০ মিলিয়ন ডলার ফি’র বিনিময়ে বিভিন্ন কনটেন্টের লাইসেন্স কিনতো, সেই স্টারজ কোম্পানি হঠাৎ দাম বাড়িয়ে বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করলো। দশ গুণ বেশি দাম পরিশোধের সামর্থ্য নেটফ্লিক্সের নেই, তাই চুক্তি নবায়ন হলো না।
নেটফ্লিক্সের লাইব্রেরি থেকে সরাতে হলো ডিজনী এবং সনি ফিল্মসের সব ভিডিও। গ্রাহকরা আরেক দফায় বিরক্ত হলো, কারণ বেশি দামে তারা এখন কম কন্টেন্ট পাচ্ছে…।
গ্রাহকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায়ও নেটফ্লিক্স পিঁছু হটলো না।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে নেটফ্লিক্স জানালো, ডিভিডি রেন্টাল ব্যবসা এখন থেকে নতুন ব্র্যান্ডে চলবে, নাম – কুইকস্টার। নেটফ্লিক্স বলতে শুধু অনলাইন স্ট্রিমিং সেবাকেই বোঝাবে। দুই ব্র্যান্ডের দুই রকম সেবার জন্য গ্রাহকদের আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। আবারও গ্রাহকদের প্রতিবাদ। কিন্তু নেটফ্লিক্স কিছুই কানে তুললো না।
এর তিন মাসের মধ্যেই ধাক্কা খেলো নেটফ্লিক্স। ৮ লাখ গ্রাহক নেটফ্লিক্স ছেড়ে চলে গেল। স্টক মার্কেটে শেয়ারের দাম কমে গেল প্রায় ৭৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা সে সময় বলছিলেন, ডিভিডি রেন্টাল মার্কেট ছিল এক রকম “ক্যাশ কাউ”। এভাবে মেরে ফেলার আগে প্রচুর “দুধ-মাংশ” পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, যা দিয়ে অনায়াসে স্ট্রিমিং সার্ভিসকে আর্থিকভাবে সমর্থন দেয়া যেতো।
অরিজিনাল কন্টেন্ট
২০১২ সালের শুরুতে নেটফ্লিক্স দেখলো স্ট্রিমিং সার্ভিসের গ্রাহক ক্রমশঃ বাড়ছে, অন্যদিকে ডিভিডি রেন্টালের ক্ষেত্রে কমছে। ২০১২ সালের শেষের হিসাবে একজন গ্রাহক মাসে গড়ে ৪০ ঘন্টা নেটফ্লিক্স দেখেছে।
দর্শকের নতুনত্ব দেয়ার প্রয়াস থেকে নেটফ্লিক্স তার নিজস্ব কন্টেন্ট প্রকাশ করে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, নেটফ্লিক্স অরিজিনাল ব্যানারে মুক্তি দেয় পলিটিক্যাল ড্রামা হাউজ অব কার্ডস। অল্প সময়েই আরো অরিজিনাল সিরিজ এবং সিনেমা যুক্ত হয় নেটফ্লিক্সে। তবে, হাউজ অব কার্ডস কিংবা অরেঞ্জ ইজ দ্য নিউ ব্ল্যাক ছাড়া অন্যগুলো দর্শকের প্রশংসা কুড়াতে পারেনি। তবে এতে হতাশ হয়নি নেটফ্লিক্স। সে সময় একজন বিশেষজ্ঞের মতামত ছিল, “প্রতিটা শো হিট হবে না। এক ডজনে একটা বা দুইটা হিট হবে। তাই, কোয়ালিটি আনতে হলে আগে অরিজিনাল কন্টেন্টের কোয়ান্টিটি বাড়াতে হবে”।
নেটফ্লিক্সের লক্ষ্য উদ্দেশ্যও ওরকম ছিল। তবে, অরিজিন্যাল কন্টেন্ট প্রোডাকশনের খরচ ছিল অনেক। কম বাজেটের হাশ করতে খরচ হয়েছে ১ মিলিয়ন ডলার। আবার বিগ বাজেটের দ্য ক্রাউনের প্রতি এপিসোডের বাজেট ছিল ১৩ মিলিয়ন ডলার।
তাই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেটফ্লিক্স লাইসেন্সিং করা ভিডিওর ওপর নির্ভর করলো।
তবে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নেটফ্লিক্স হাল ছাড়েনি।
সিনেম্যাচের এলগরিদমের ওপর ভিত্তি করে নেটফ্লিক্স ডাটা অ্যানালাইসিস করে গ্রাহকদের প্রায় ২০০০ সেগমেন্টে ভাগ করে। এদের নাম দেয় “টেস্ট কম্যুনিটি”। যেমন, কারা থ্রিলার দেখে এবং ক্রাইম সিরিজ দেখে, কারা ডকুমেন্টারি দেখে কিন্তু কমেডি দেখে না; এরকম ২০০০ পারমুটেশন কম্বিনেশন। এ বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে নেটফ্লিক্স প্ল্যান করলো – কোন স্ক্রিপ্টরাইটার কাহিনী লিখবে, কে অভিনয় করবে, কোথায় শ্যুটিং হবে। একেবারে কাস্টমার ফোকাসড পরিকল্পনা।
অরিজিনাল সিরিজের মাধ্যমে নেটফ্লিক্স নতুন এক প্রতিযোগীর মুখোমুখি হলো – ক্যাবল চ্যানেল এইচবিও। অন্যদিকে অ্যামাজন এবং হুলুও অরিজিন্যাল কন্টেন্ট নিয়ে এসেছে। ২০১১ সালে হুলুর দ্য মর্নিং আফটার, দ্য কনফেশন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দর্শকের নজর কেড়েছে ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া অ্যামাজনের আলফা হাউজ এবং বেটাস।
অরিজিনাল কনটেন্ট বানাতে গিয়ে নেটফ্লিক্সের খরচ বেড়েছে বহুগুণ।
ফলে, বাড়তি দামের ভার চেপেছে গ্রাহকের ঘাঁড়ে।
২০১৩ সালে মাসে ১১.৯৯ ডলারে নেটফ্লিক্স প্রিমিয়াম প্যাকেজ আসে – একসাথে চারটা ডিভাইসে স্ট্রিমিং করা যেতো।
পরের বছর, ২০১৪ সালে, স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজের দাম ১ ডলার বাড়ে। এ প্যাকেজে একসাথে দুইটা ডিভাইসে এইচডি ভিডিও স্ট্রিমিং করা যেতো। উল্লেখ্য, এই বাড়তি দাম কেবল নতুন গ্রাহকদের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। পুরনোরা আরও দুই বছর আগের দামে সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা পেলো।
এ সময়ে আরো এক নতুন প্যাকেজ অফার করে নেটফ্লিক্স। মাসে ৭.৯৯ ডলারে সিংগেল স্ক্রীনে স্ট্যান্ডার্ড ডেফিনিশন ভিডিও দেখাবে এই “নেটফ্লিক্স ব্যাসিক”।
২০১৫ সালের অক্টোবরে নেটফ্লিক্সের স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজের নাম এক ডলার বাড়িয়ে মাসে ৯.৯৯ ডলার করা হয়। আবারও বলা হয়, এ কেবল নতুন গ্রাহকদের জন্য, পুরনো গ্রাহকদের জন্য এ বাড়তি হার কার্যকর হবে ২০১৬ সালের মে থেকে।
এই যে দফায় দফায় পরিবর্তন, নানান শর্তের ফাঁকফোঁকর; এসবে অধিকাংশ কিন্তু গ্রাহকদের নজরে আসেনি। কারণ, ২০১৬ সালের এপ্রিলে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় – ৮০% গ্রাহক এসব বাড়তি দামের কথা জানতো না। এদের ৪০% গ্রাহক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিল, তারা নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে দেবে।
অথচ, বাস্তবে দেখা গেল মাত্রে ৩-৪ শতাংশ গ্রাহক সে সময় নেটফ্লিক্স ছেড়েছে। আবার ছেড়ে যাওয়া গ্রাহকের ৫০% কিছুদিনের মধ্যেই নেটফ্লিক্সে ফিরে এসেছে।
বাড়তি দামের ব্যাপারে নেটফ্লিক্সের সিএফও ডেভিড ওয়েলস বলেন – “নেটফ্লিক্সের লক্ষ্য এর লাইব্রেরির অর্ধেক কন্টেন্ট হবে অরিজিনাল। সেরা মানের সেরা প্রোগ্রামের জন্য একটু বাড়তি দাম দর্শকদের সইতেই হবে”।
ডেভিডের এ কথায় গ্রাহকরা হয়তো ভরসা পেয়েছে। তাই দেখা যায়, ২০১৭ সালে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা, ১৯০টি দেশজুড়ে মোট ১০০ মিলিয়নে পৌঁছেছে। নেটফ্লিক্সের ৯০টিরও বেশি অরিজিনাল কন্টেন্ট এমি অ্যাওয়ার্ডে নমিনেশন পেয়েছে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের টি-মোবাইলের সঙ্গে স্ট্রিমিং পার্টনারশীপ করে নেটফ্লিক্স। একই রকমভাবে হুলু পার্টনারশীপ করে স্প্রিন্টের সঙ্গে।
সাফল্যের
সিঁড়ি বাইতে বাইতে নেটফ্লিক্সের ঝুড়িতে দেনার পরিমাণও বেড়েছে অনেক; ২০১৩ সালে ছিল ৫০০
মিলিয়ন ডলার,
যেটা ২০১৭ সালের শেষে এসে হয় ৬ বিলিয়ন ডলার। নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষ এবং
এর বিনিয়োগকারীরা একটা বিষয়ে একমত হন যে, কেবল গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধিই হতে পারে আর্থিক
চাপ সামাল দেয়ার শক্ত হাতিয়ার।
ফলে, ২০১৭ সালের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাহকরা আরেক দফা বাড়তি দামের সম্মুখীন হয়। স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজের দাম ৯.৯৯ থেকে বেড়ে ১০.৯৯ এবং প্রিমিয়াম প্ল্যানের দাম ১১.৯৯ থেকে বেড়ে ১৩.৯৯ ডলার করা হয়।
দাম বাড়ানোর পরে আবারও গ্রাহকদের মাঝে হাউকাউ শোনা যায়। তবে, আগের মতোই গ্রাহক সংখ্যায় কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং ২০১৭ সালের শেষ তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ২০ লাখ এবং বিশ্বের বাকী দেশে ৬০ লাখ নতুন গ্রাহক পায় নেটফ্লিক্স।
২০১৯ – আবার দাম বাড়ালো নেটফ্লিক্স
নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে সবচে বেশি মাত্রার দাম বাড়ে ২০১৯ সালে।
প্রিমিয়াম প্ল্যান – ১৩.৯৯ ডলার থেকে বেড়ে ১৫.৯৯ ডলার,
স্ট্যান্ডার্ড প্ল্যান – ১০.৯৯ থেকে বেড়ে ১২.৯৯, এবং
ব্যাসিক প্ল্যান – ৭.৯৯ থেকে বেড়ে ৮.৯৯ ডলারে নির্ধারিত হয়।
দাম বাড়ানো নিয়ে নেটফ্লিক্সের ব্যাখ্যা ছিল এমন – গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া অর্থই নেটফ্লিক্সের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের মূল ভিত্তি। এখন একটি বেশি বিল দিয়ে ভবিষ্যতে ভালো মানের কনটেন্ট দেখার সুযোগ দর্শক নিজেই তৈরি করছে।
তবে, ২০১৮ সালে কন্টেন্টের পাশাপাশি নেটফ্লিক্সের বড়সড় বিনিয়োগ ছিল তথ্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নে – প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার।
২০১৯ সালের দাম বাড়ানোর পরে এক জরিপে ২৫% গ্রাহক বলেছিল তারা অন্য সস্তা প্ল্যাটফরমে সুইচ করার কথা ভাবছে। দুই-তৃতীয়াংশ ভোক্তা বলেছে, প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন বিরতি থাকুক – তবুও নেটফ্লিক্সের বিল যেন সস্তা হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ২৬ হাজার গ্রাহক নেটফ্লিক্স ছেড়ে চলে যায়, ফলে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাহকের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬০.১ মিলিয়ন।
তবে কেবল দাম বাড়ার কারণে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক কমেছে, এমন কথা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।
এনবিসি ইউনিভার্সেল এবং ওয়ার্নারমিডিয়া এর মাঝে তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু করার পাশাপাশি নেটফ্লিক্স থেকে তাদের নিজস্ব কন্টেন্টগুলো সরিয়ে নিয়েছে।
এ সময় বাজারে আরও এসেছে
ডিজনী+
অ্যাপেল টিভি+
এইচবিও ম্যাক্স
এনবিসি পীকক
নতুন এ প্ল্যাটফরমগুলো গ্রাহকদের ফ্রি ট্রায়াল এবং ডিসকাউন্ট দিলো। ফলে, ধারণা করা হয় – নতুন আসা প্ল্যাটফরমগুলো যাচাই করতে অনেক গ্রাহক ও সময় নেটফ্লিক্স ছেড়ে গেছে। এরপরেও নেটফ্লিক্সের আয়ের যে স্রোত, বলা হয় তার বেশিরভাগ আসছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের মার্কেট থেকে – যেখানে সাবস্ক্রিপশন ফি অনেক কম।
২০২০ সাল – সুযোগ এবং শংকার বছর
২০২০ সালে এসে স্ট্রিমিং যুদ্ধের ময়দান অনেক বদলে গেছে। বাজারে নতুন নতুন অফার এবং সেবার বৈচিত্র্যের কারণে দেখা যাচ্ছে একজন গ্রাহক একাধিক স্ট্রিমিং সার্ভিসের গ্রাহক হচ্ছেন। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বিভিন্ন স্ট্রিমিং সার্ভিস বাবদ একজন গ্রাহক মাসে গড়ে ৪৪ ডলার দিতে রাজী আছে। এর প্রভাব পড়েছে ক্যাবল টিভির ব্যবসায়। যুক্তরাষ্ট্রে মাসে ৮৫ ডলার দামের ক্যাবল টিভি সাবস্ক্রিপশন বাতিল করেছে প্রায় ৫৫ লাখ গ্রাহক।
এক হিসাব মতে বিশ্বব্যাপী স্ট্রিমিং সার্ভিসের বাজার প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো, গ্রাহক সংখ্যা ১.২ বিলিয়ন।
তবে আশংকার কথা হচ্ছে – উন্নত বিশ্বে স্ট্রিমিং সার্ভিসের বাজার স্তিমিত হয়ে আসছে খুব দ্রুত। অন্যদিকে অনুন্নত দেশগুলোর গ্রাহকরা পয়সা খরচ করে নাটক সিনেমা দেখতে আগ্রহী না। তারা অবৈধ ডাউনলোড ও অন্যান্য মাধ্যমে বেশি উৎসাহী।
মার্কেট লিডার হিসেবে নেটফ্লিক্স অন্যদের চেয়ে সব সময় এগিয়ে থেকেছে।
১৯০টি দেশজুড়ে ১৮০ মিলিয়নের বেশি স্ট্রিমিং গ্রাহক, প্রায় ১৪ হাজার নাটক সিনেমার টাইটেল নিয়ে নেটফ্লিক্সের অবস্থান বেশ শক্ত।
এর বাইরে, ২ মিলিয়নের বেশি গ্রাহক এখনো নেটফ্লিক্সের ডিভিডি রেন্টাল সেবা (ডিভিডি ডট কম) নিচ্ছে। ২০১৯ অর্থ বছরে নেটফ্লিক্সের আয় ২০.২ বিলিয়ন ডলার, নেট ইনকাম ১.৯ বিলিয়ন ডলার।
এই মুহূর্তে নেটফ্লিক্সকে বলা হচ্ছে আমেরিকান বিনোদনের জগতে সবচে’ শক্তিশালী মাধ্যম। নেটফ্লিক্স শো’র সুবাধে অনেক নতুন নতুন মুখ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তারকাখ্যাতি উপভোগ করছে। এরপরেও নেটফ্লিক্সের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতাকেই এ অনিশ্চয়তার মূল হেতু হিসেবে ধরা হচ্ছে। এর বাইরে,
১) বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিভিন্ন অফারে গ্রাহকরা একরকম বিরক্তও হচ্ছে;
২) অরিজিনাল কন্টেন্টের চাহিদা সামাল দিতে পারছে না নেটফ্লিক্স;
৩) তার ওপর যোগ হয়েছে কোভিড প্যানডেমিক।
গবেষণা বলছে, বিভিন্ন অফারে গ্রাহকরা কেবল বিরক্তও হচ্ছে তা না, ক্লান্তি এবং বিষাদও ভর করছে। এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে ডিজনী। বান্ডেল অফারে ডিজনী+, হুলু এবং ইএসপিএনের সার্ভিস পাওয়া যাবে মাসে ১২.৯৯ ডলারে। ২০২০ সালের মার্চের হিসেবে স্ট্রিমিং সার্ভিসের নতুন গ্রাহকরা ডিজনী+ এবং হুলুর দিকে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
তবে নেটফ্লিক্সের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ একেবারেই কম না।
২০২০
সালের জানুয়ারি-মার্চ মাসে নেটফ্লিক্সে ১৬ মিলিয়ন নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়েছে, এর ১৩.৫
মিলিয়ন হলো ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটের (যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে)। ধারণা করা হচ্ছে, কোভিডের
কারণে, সারা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষ যখন লক ডাউনে আঁটকা, তখন ঘরে বসে বিনোদনের উপায়
হিসেবে মানুষ নেটফ্লিক্স বেছে নিয়েছে। এই মহামারী কালে পাওয়া গ্রাহক নিয়ে নেটফ্লিক্স
খুব উচ্ছ্বসিত না। কারণ, এসব গ্রাহক দীর্ঘমেয়াদের নেটফ্লিক্সের সঙ্গে থাকবে কিনা সেটা
এক বড় শংকা। কারণ, করোনা মহামারীর কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ধ্বসে যাচ্ছে, শেয়ার
বাজার অস্থির হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য সংকুচিত হচ্ছে, লোকজন চাকরী হারাচ্ছে, বেকারত্ব
বাড়ছে।
এতো সব সংকটের মাঝে গ্রাহকরা বিনোদনের পেছনে কতোটুকুই খরচ করবে?
করোনা কালে “ঘরে থাকার দিনগুলোতে” স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো আরেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। অরিজিনাল কন্টেন্টের প্রোডাকশন শিডিউল পিঁছিয়ে গেছে। প্রভাব পড়েছে ভিডিও তালিকায়, কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশনে। এমন কী ইএসপিএন প্লাসের বিজ্ঞাপন খাত থেকে আয়ও কমে গেছে অনেক। তবে নেটফ্লিক্সের ভাগ্য ভালো। মানি হাইস্টের মতো জনপ্রিয় বেশ কিছু শো’র প্রোডাকশন করোনা সংকটের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিযোগিতার মাঠে এখানে নেটফ্লিক্স অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিল। নেটফ্লিক্সের প্রত্যাশা ছিল ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে মোট গ্রাহক সংখ্যা ১৯০ মিলিয়ন হবে।
তবে এই সংখ্যা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা যাবে কিনা সেটাই এই মুহূর্তের সবচে’ বড় জিজ্ঞাসা।
এ জিজ্ঞাসার সঙ্গে নেটফ্লিক্স আবারও দায় দেনা এবং বিনিয়োগের দিকে তাকাচ্ছে। ভাবছে, সামনের যাবতীয় অনিশ্চয়তা সামাল দিতে আরেক দফা দাম বাড়াবে কিনা। নেটফ্লিক্সের মনে একটাই সাহস, অতীত ইতিহাস বলছে – দাম বাড়ালেও যে পরিমাণ গ্রাহক নেটফ্লিক্স ছেড়ে চলে যায় তার প্রভাব খুব নগণ্য। ২০২০ সালের মে মাসের জরিপে ৫৫% গ্রাহক বলেছে, বাড়তি দাম দিয়ে হলেও তারা নেটফ্লিক্সের সেবা নিবে। এ সাহসের ভিত্তিতেই সেপ্টেম্বরে এসে অস্ট্রেলিয়ার বাজারে গ্রাহক ফি বাড়িয়েছে নেটফ্লিক্স।
কিন্তু দাম বাড়ানোই কি একমাত্র সমাধান?
এভাবে কতোদিন চলবে নেটফ্লিক্স?
স্ট্রিমিং ইন্ডাস্ট্রির লিডার হিসেবে নেটফ্লিক্স কি নতুন কোনো উপায় খুঁজবে সামনে?
***
নোট:
এ লেখার মূল সুত্র হার্ভার্ড বিজনেস কেইস Pricing at Netflix.
No comments:
Post a Comment