কোলাহলে কম্যুনিকেশন

বাজারে অফারের কমতি নেই।

কিন্তু অফার দিয়েই ব্র্যান্ডগুলো নিশ্চিন্তে বসে থাকছে না। চিৎকার করে জানান দিচ্ছে – কী তার বিশেষত্ব, কেন সে সেরা।

এ প্রসঙ্গে আমরা ব্র্যান্ড ডিফারেনসিয়েশন লেখাটির কথা স্মরণ করতে পারি, যেখানে আমরা জেনেছি একটি ব্র্যান্ড অন্য ব্র্যান্ডের চেয়ে কীভাবে আলাদা হয়ে ওঠে।

আরও বড় বাস্তবতা হলো – কতোটুকু আলাদা হতে পারলো তার দিকে নজর না দিয়ে ব্র্যান্ডটি যে আলাদা; সে প্রচার এবং প্রসার চলছে অবিরাম।

বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ইত্তেফাক-সংবাদসহ হাতেগোণা কিছু মিডিয়ার মনোপলিতে ভাঙ্গন ধরেছে আরো ২৫ বছর আগে। স্যাটেলাইট চ্যানেল এলো, ডজনের বেশি টিভি চ্যানেল এলো; দর্শক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল, কিন্তু বিজ্ঞাপনের কমতি হলো না। বিশাল বাজারের ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে নব্বইয়ের দশক এবং এই শতকের শুরুর দিকে ক্রিয়েটিভ ম্যাসেজ এবং জিঙ্গেলে কেমন ছিল বিজ্ঞাপনের জগত তা ইউটিউবে “নব্বইয়ের দশকের স্মৃতি জাগানিয়া বিজ্ঞাপন”-এর ভিডিও দেখলেই বোঝা যাবে।

তবে মুশকিল হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।

ইন্টারনেটের দ্রুতগতি, সহজলভ্যতা এবং স্ট্রিমিং সার্ভিসের জয়জয়কারে একই ঘরে তিনজন মানুষ তিনটি ডিভাইসে আলাদা আলাদা কনটেন্ট দেখছেন। তবে, সেখানেও বিজ্ঞাপন থেকে মুক্তি নেই। ইউটিউবের ভিডিওতে মিনিটে মিনিটে আসছে বিজ্ঞাপন, দর্শকও সুযোগ বুঝে “স্কিপ অ্যাড”-এ ক্লিক করছেন।

বিজ্ঞাপন এড়িয়ে যাওয়ার এ প্রবণতা নতুন নয়।

পুরনো এক হিসাব বলছে – একজন দর্শক রাতে দেখা টিভি বিজ্ঞাপনের মধ্যে মাত্র ৬% বিজ্ঞাপনকে পরদিন স্মরণ করতে পারেন। অর্থ্যাৎ বাকী ৯৪% বিজ্ঞাপন তার মনে-মগজে কোথাও জায়গা নিতে পারছে না। টিভিতে বিজ্ঞাপন এলেই চ্যানেল পালটানো, পত্রিকার পাতা উল্টাতে বিজ্ঞাপন দেখলে এড়িয়ে যাওয়া; এগুলো অনেক পুরনো ব্যাপার। ফেসবুকের ফীডের আশেপাশে ঘুরঘুর করা স্পন্সর্ড বিজ্ঞাপন কতোটাই বা আর চোখে পড়ে। ফলে সংকটে পড়েছে ব্র্যান্ডগুলো। কী করলে, কীভাবে বললে কাস্টমারের নজর কাড়া যাবে; সে নিয়ে চলছে গবেষণা।

মার্কেটিং গবেষকদের মাঝে অন্যতম প্রফেসর ব্যারি জে ব্যাবিন, এখন পড়াচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপিতে। বিজ্ঞাপনে-প্রচারে-প্রসারে অর্থ্যাৎ সার্বিক কম্যুনিকেশনে তীব্র কোলাহলের ভীড়ে ভোক্তার দৃষ্টি দখলের জন্য তিনি ৬ টি পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর পরামর্শকে সংক্ষিপ্ত করে নোট রাখতেই এ লেখা।



১) বক্তব্য/বিষয়ে তীব্রতা (intensity)
 
প্রফেসর ব্যাবিন বলেছেন “Consumers are likely to pay attention to stronger stimuli than to weaker stimuli. A brightly colored television ad would better capture an individual’s attention than a less colored ad.”

একটি বিজ্ঞাপনে একাধিক বিষয় থাকতে পারে। কিন্তু, কোন বিষয়ের প্রতি আপনি ভোক্তার নজর টানতে চাচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে আমরা সাম্প্রতিক সময়ের রূপায়ন লেক ক্যাসেলের বিজ্ঞাপনটিতে তাকাতে পারি।





লক্ষ্য করলে দেখবেন, বিজ্ঞাপনটিতে রূপায়ন লেক ক্যাসেল, বসুন্ধরা, ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অব পিস, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ফ্ল্যাট সাইজ, একাধিক ফোন নম্বরসহ প্রায় ডজন খানেক তথ্য আছে। বিজ্ঞাপনটির নান্দনিকতাকে আলাদা করে রাখলে, যে বিষয়টি প্রধান হয়ে ওঠে তা হলো তাহসানের উপস্থিতি। বিজ্ঞাপনটির মেসেজ এক্সিকিশনে সমস্যা অনেক। এই যে বহুতল ভবনের সঙ্গে তাহসানের শরীর ভিজ্যুয়ালি মিশে গেছে তার মানে কী? কিংবা তাহসান কী বলতে চাচ্ছেন? এসবের কোনো বালাই নেই। অথচ খুব সম্ভাবনা আছে তাহসানের কারণেই বিজ্ঞাপনটি পাঠকের নজর কাড়বে। এ বিজ্ঞাপনে তাহসানের উপস্থিতি নজরে আসার মতোই তীব্র।

একইভাবে সম্প্রতি দুবাইয়ে কেএফসির বিজ্ঞাপনটির দিকে তাকানো যায়।





হ্যালোইন উপলক্ষ্যে করা এ বিজ্ঞাপনে চার শব্দের হরর গল্প হিসেবে “A world without KFC”-র এক্সিকিউশন একদিকে যেমন মনে-মগজে পৌঁছায়, তেমনি ভয়ের গল্প বলতে গিয়ে অডিয়েন্সের মুচকি হাসি এবং প্রশংসাও আদায় করে।


২) বৈপরীত্য (contrast)

অর্থ্যাৎ, বিজ্ঞাপনের রঙ এবং উপাদানের বৈপরীত্যের মাধ্যমে নজর কাড়তে বলা হয়। এ বিষয়ে তাত্ত্বিক কথা না বলে উদাহরণেই যাই।

২০০৭ সালের মেলবোর্ন ফুড ফেস্টিভ্যালের এ বিজ্ঞাপন বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। বিজ্ঞাপনের কনটেন্টের মাঝে কনট্রাস্ট দিয়ে চমৎকার মেসেজ দেয়া হয়েছে।





কোকা-কোলার অনেক বিজ্ঞাপনে একই ধারা দেখা গেছে।





৩) গতিময়তা (movement)

টিভি বিজ্ঞাপনে সবকিছু চলমান – ঘুরছে, নড়ছে; স্থির নেই। সে তুলনায় প্রিন্ট এবং আউটডোরের বিজ্ঞাপন স্থির ছিল অনেক বছর। প্রযুক্তির গতিতে একদিকে যেমন স্থির সাইনেজে আলোর কারিশমা এসেছে। ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন




তেমনি এককালের স্থির বিলবোর্ডগুলো হয়ে গেছে ভিডিও স্ক্রীণ। সেখানেও এসেছে বৈচিত্র্য।

এ বছর রেডমি কে৪০ মোবাইলের থ্রি ডি বিলবোর্ড চমৎকার এক উদাহরণ। ভিডিওটি দেখতে পারেন –




৪) বিষ্ময় (surprise)

যা থাকার কথা নয়, যা দেখার কথা নয় – তা থাকা এবং দেখাই হচ্ছে দর্শকের চোখে বিষ্ময়। চোখ এবং মন আকর্ষণের জন্য চমকে দেয়ার ক্ষমতা অসীম। অপ্রত্যাশিত কনটেন্টের মাধ্যমে ভোক্তাদের নজর কেড়েছে অনেক বিজ্ঞাপন। স্প্রাইটের Sprite Shower ক্যাম্পেইনের কথাই ধরা যাক





২০১২ সালে এ আউটডোর ক্যাম্পেইনে সমুদ্র সৈকতে বিশাল সাইজের ডিসপেন্সার বুথ স্থাপন করেছিল স্প্রাইট। তবে সেখানে সুইচ টিপলে স্প্রাইট নয়, স্রেফ পানি পড়েছিল। সমুদ্র সৈকতে গড়াগড়ি/সাতাঁর দেয়া মানুষদের শরীর থেকে বালি সরানোর জন্য এ শাওয়ার বুথ বেশ নজর কেড়েছিল।





বিজ্ঞাপনে “সারপ্রাইজ” কীভাবে কাজ করে, কী এর কার্যকারিতা; জানতে এ লেখাটি পড়তে পারেন। অনলাইনে এক্সেস পেলে এটিও ভালো লাগবে।

 
৫) বিশাল আকার/আকৃতি (Size)

বিজ্ঞাপনের অনেকক্ষেত্রেই “সাইজ ডাজ ম্যাটার”।
এ কোলাহলের জগতে অন্যের প্রচারকে ‘ক্ষুদ্রতর’ করতে নিজের প্রচারকে ‘বৃহত্তর’ করা চমৎকার এক কৌশল। থিয়রিতে একে “গেরিলা অ্যাডভার্টাইজিং” বলা হয়। উদাহরণ? নিচের চারটি বিজ্ঞাপন –

















৬) সম্পৃক্ততা (involvement)

এক্ষেত্রে বলা হয় – বিজ্ঞাপনে অডিয়েন্সকে সম্পৃক্ত করুন।
বক্তব্যকে একমূখী না করে ব্র্যান্ডের সঙ্গে, বিজ্ঞাপনের সঙ্গে অডিয়েন্সকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করুন। ডাভের রিয়েল বিউটি ক্যাম্পেইন বরাবরই টার্গেট অডিয়েন্সকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছে।





শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞাপনে ওয়েট ওয়াচার্সও একই পন্থা নিয়েছে।





প্রফেসর ব্যাবিনের এই ৬ তরিকা মার্কেটিং কম্যুনিকেশনের মৌল পর্যায়ের পরামর্শ। সময় পাল্টাবে, বিজ্ঞাপনের হাতিয়ার (tools) পাল্টাবে, কিন্তু কিছু টেকনিক অব্যর্থ থেকে যাবে।


পরিশিষ্ট –

কোলাহলময় বাজারে ভোক্তার সঙ্গে সফল যোগাযোগ সৃষ্টির জন্য মার্কেটিং কম্যুনিকেশন এবং ব্র্যান্ডিং বিশেষজ্ঞরা আরেকটি বিষয়ের উপরে জোর দেন। তা হলো – consistency. মানে, যা বলবেন তাতে যেন ধারাবাহিকতা থাকে।

অনেক সময় ব্র্যান্ডগুলো বিজ্ঞাপন এবং বার্তায় এতো দ্রুত এবং বেশি বেশি পরিবর্তন আনে যে ব্র্যান্ডের আইডেন্টিটি অর্থ্যাৎ স্বরূপটাই সংকটে পড়ে।

ব্র্যান্ডের যুদ্ধ চলে ভোক্তার মনে ও মগজে।

মোটামুটি ছয় ইঞ্চি সাইজের ব্রেইনের মধ্যে জায়গা দখলের জন্য ব্র্যান্ডে ব্র্যান্ডে সংগ্রাম সংঘাত চলছে। সে সংগ্রামে সংঘাতে যুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে ভোক্তাকে বিভ্রান্ত করার মতো ভুল আর নেই।

তাই কম্যুনিকেশনে কনসিস্টেনসি থাকা খুব প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞাপনে ও বার্তায় কনসিস্টেনসি দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ব্র্যান্ড “পেট সাফা”।















এর বাইরে প্রায় দুই ডজনের কাছাকাছি বিজ্ঞাপন করেছে “পেট সাফা”।

বাজারে কতোটা সফল হয়েছে তার তথ্য প্রকাশ্যে না এলেও, কনসিস্ট্যান্সিতে এ ক্যাম্পেইনের থিঙ্কট্যাঙ্করা প্রশংসার দাবী রাখেন।




No comments:

Post a Comment