ব্র্যান্ড লয়্যালটি মারা যাচ্ছে?

ব্যক্তিগত জীবনে আপনি যদি ধার্মিক হন, ঈশ্বরে অগাধ আস্থা রাখেন, আপনার সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন; তাহলে অন্যদের তুলনায় আপনার ব্র্যান্ড লয়্যাল হওয়ার সম্ভাবনা কি বেশি?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আমরা একটু পরে...।

শুরুতে ব্র্যান্ড লয়্যালটি বিষয়ক প্রাথমিক কিছু আলাপ করা যাক।

 
ব্র্যান্ড লয়্যালটির সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে – কাস্টমার কোনো একটা ব্র্যান্ড নিয়মিত কিনবে, ব্যবহার করবে। প্রতিযোগী ব্র্যান্ডগুলো দাম কমালেও কাস্টমার সেদিকে যাবে না।

ব্র্যান্ড লয়্যালটির আরেক ব্যাখ্যা হলো – বর্তমানে হাতে কাস্টমার যারা আছে ওদের ধরে রাখা; নিশ্চিত করা যে, ওরা বারবার ফিরবে আসবে, কিনবে। ফলে, একদিকে বিজ্ঞাপন খাতে খরচ কমবে, অন্যদিকে মুনাফাও বাড়বে। আবার এসব লয়্যাল কাস্টমাররা পাড়া প্রতিবেশি বন্ধু বান্ধবদের কাছে ব্র্যান্ডটির প্রশংসা করবে, কিনতে পরামর্শ দেবে যাকে ওয়ার্ড-অব-মাউথ বলা হয়। এর একটা সুবিধা হলো, সম্ভাব্য কাস্টমাররা কোম্পানীর প্রচারিত বিজ্ঞাপনের চেয়ে চেনা-জানা-মানুষের মুখের কথাকে বেশি বিশ্বাস করে। ফলে, লয়্যাল কাস্টমার কেবল নিজেই ব্র্যান্ডটি কেনে না, বরং অন্যদের ঐ ব্র্যান্ড কিনতে উৎসাহিত করে। ব্র্যান্ডের দিক থেকে এ যেনো লাভের ওপরে লাভ, সেরের ওপরে সোয়া সের।

মোদ্দাকথা, একেবারে নতুন কাস্টমার টানার চেয়ে হাতে থাকা বর্তমান কাস্টমার ধরে রাখা সুলভ এবং লাভজনক। গবেষণা সংস্থা বেইন অ্যান্ড কো বলছে, কাস্টমার রিটেনশন ৫% বাড়ালে, মুনাফা ২৫%-৯৫% পর্যন্ত বাড়তে পারে।


ব্র্যান্ড লয়্যালটি কমছে কেন?
প্রথমতঃ ইন্টারনেটের বিস্ফোরণ। ঘরে বসে হাতের মুঠোয় এক ক্লিকে হাজার হাজার অফার চলে আসছে কাস্টমারের মোবাইল/কম্পিউটারের স্ক্রীণে। শত শত বিকল্প হাতের নাগালে আসছে সস্তায় ও সহজে। ফলে, অন্য ব্র্যান্ড দাম কমালেই কাস্টমাররা সেখানে সুইচ করছে।

দ্বিতীয়তঃ বাজারে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা। অনেক আগে বাজারে সরবরাহ ছিল কম। সাবানের কথাই ধরি, তখন তিন-চার বা পাঁচ রকম সাবান পাওয়া যেতো কোনো দোকানে। এখন সুপরিসর সুপার মার্কেটে ডজন ডজন সাবানের ব্র্যান্ড। যেহেতু প্রতিযোগিতা বেশি, ভোক্তাকে খুশি করে বাজার দখলের চেষ্টা করছে বিক্রেতা/ব্র্যান্ড; সেহেতু দরকষাকষির ক্ষমতার সিংহভাগ চলে গেছে ভোক্তার হাতে। এই ফাঁকে, ভোক্তার প্রত্যাশা (কাস্টমার এক্সপেক্টেশন) বেড়ে গেছে অনেক। এই আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণে যখনি কোনো ব্র্যান্ড ব্যর্থ হচ্ছে, তখনো ভোক্তা চলে যাচ্ছে অন্য ব্র্যান্ডের ঘরে। 

এ সময়ের কাস্টমারদের এক্সপেক্টেশন কতোটা বেড়ে গেছে সেটা বোঝা যাবে নিচের তথ্যগুলোর দিকে তাকালে –
১) অনলাইন সেবার ক্ষেত্রে ৭১% কাস্টমার প্রত্যাশা করে ৫ মিনিটের মধ্যে সাহায্য পাওয়া যাবে
২) ফোন আলাপে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া না গেলে, ৫২% কাস্টমার ঐ দোকানে আর যাবে না
৩) প্রতি ১০০জন অসন্তুষ্ট কাস্টমারের ৯৫ জন নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা অন্যদের সাথে শেয়ার করে


য়্যাল রাখার জন্য কী করা যায়?
লয়্যালটি কার্ড তো অনেক পুরোনো টেকনিক। রেগুলার কাস্টমারদের ফ্রি জিনিসপাতি দেয়া যায়। তবে, এই ফ্রি দেয়ার একটা সমস্যা হলো – ফ্রি পেয়ে পেয়ে অভ্যাস হয়ে গেলে, পরে কখনো ফ্রি না পেলে কাস্টমার আবার রাগ করে। এক্ষেত্রে একটা বড়সড় প্রশ্ন দাঁড়ায় – “কাস্টমাররা আসলেই লয়্যাল নাকি সুবিধাবাদী?” প্রাসঙ্গিকভাবে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর ২০১৭ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত এক লেখার শিরোনামই ছিল Customer loyalty is overrated.
 
লয়্যালটি প্রোগ্রাম বিষয়ক এক রিপোর্ট জানাচ্ছে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ২০১৭ সালে ৩.৮ বিলিয়ন লয়্যালটি প্রোগ্রাম মেম্বার ছিল। এই সংখ্যাটি ২০১৬ সালের তুলনায় ১৫% বেশি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে – প্রায় ৪ বিলিয়ন মেম্বারের অর্ধেকের বেশি (৫৪%) প্রায় নিষ্ক্রিয় বললেই চলে, মানে কালেভদ্রে কিছু কিনে। অন্যদিকে, ২৮% মেম্বার জীবনে একবারের জন্যও লয়্যালটি কার্ড ব্যবহার করেনি। লয়্যালটি কার্ড পেয়েছে কিন্তু ব্যবহার করে না; এমন কাস্টমারদের মূল অভিযোগ হলো – লয়্যালটি কার্ড ব্যবহার করে পয়েন্ট পেতে অনেক দীর্ঘ সময় লেগে যায়; লাভের লাভ কিছুই হয় না।

এখন যেটা বলা হচ্ছে তা হলো, কাস্টমাইজ অফার। মানে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা অফার। অনলাইনের কারণে ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে। অনলাইন বুক শপের সাইটে দেখবেন, আপনি যখনি ২-৪টা বইয়ে ক্লিক করবেন, সাথে সাথে নিচে/পাশে একই ধাঁচের আরো কিছু বই আপনাকে সাজেস্ট করবে। “ইয়্যূ মে অলসো লাইক” টেকনিক। 

কাস্টমারের জন্মদিনে, বিবাহ বার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইমেইল, কার্ড এমনকী ফোন কলও খুব জনপ্রিয় হচ্ছে আজকাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন – এরকম বিশেষায়িত শুভেচ্ছা বিনিময় কার্যকরী, কারণ এগুলো কাস্টমারের আবেগকে স্পর্শ করে। “আবেগে কাইন্দালাইছি” অবস্থা না হলে, নিজস্ব বিশেষ দিনে বা উপলক্ষে শুভেচ্ছা/শুভকামনা পেয়ে ব্র্যান্ডের প্রতি একরকম সফট কর্ণার জন্মায়।

গত এক দশকে ব্র্যান্ডগুলো কম্যুনিটি তৈরিতে নজর দিচ্ছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া – ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে ফলোয়ার বাড়িয়ে কাস্টমার-টু-কাস্টমার যোগাযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে, অনলাইনে ব্র্যান্ডের ফ্যান-ফলোয়াররা কমেন্টে আলাপে নিজের পছন্দের ব্র্যান্ডের পক্ষে ‘লড়াই’ করে যাচ্ছে।


শুরুতেই প্রশ্ন রেখেছিলাম - ব্যক্তিগত জীবনে আপনি যদি ধার্মিক হন, ঈশ্বরে অগাধ আস্থা রাখেন, আপনার সঙ্গীর (স্বামী/স্ত্রী/বন্ধু/বান্ধবী) প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন; তাহলে অন্যদের তুলনায় আপনার ব্র্যান্ড লয়্যাল হওয়ার সম্ভাবনা কি বেশি?

থিয়রীতে ব্র্যান্ডকে জীবন্ত মানুষের সাথে তুলনা করা হয়। ব্র্যান্ডের জন্ম আছে, মৃত্যু আছে, পার্সোনালিটি আছে, ইমেজ আছে, ইমেজ সংকট আছে, প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, লাভার আছে, হেটার আছে, ফেসবুক পেইজ আছে, লক্ষাধিক ফলোয়ারও আছে।
তাহলে, আমরা হয়তো ব্র্যান্ডকে ‘সামাজিক জীব’-ও বলতে পারি। 

নজ্যুমার-ব্র্যান্ড রিলেশনশীপ নিয়ে গবেষণার যে জগত সেখানে আমরা দেখি ভোক্তা-ব্র্যান্ডের সম্পর্ক মানবিক সম্পর্কের মতো। কাস্টমাররা ব্র্যান্ডকে পছন্দ করছে, বিশ্বাস করছে, ব্র্যান্ডের কাজকর্মে সন্তুষ্ট হচ্ছে, ভালোবাসছে, ব্র্যান্ডের প্রতি দায়বদ্ধ হচ্ছে, আনুগত্য প্রকাশ করছে, আবেগঘন সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এবং এভাবে কিছু কিছু ব্র্যান্ড ক্রমশঃ ভোক্তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে – ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মানুষের সাথে আপনি যেরকম আচরণ করেন, ব্র্যান্ডের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে আপনি কি একইরকম আচরণ করেন না?

সহজভাবে বলা যাক। ধরি, আপনি এমন একজন মানুষ যিনি সবাইকে বিশ্বাস করেন। খুব সহজেই মানুষের মুখের কথাকে বিশ্বাস করেন। তাহলে কি এমন সম্ভাবনা আছে যে কোনো ব্র্যান্ডের প্রচার-প্রসার-বিজ্ঞাপনের প্রতিও আপনি সহজে বিশ্বাস স্থাপন করবেন?

বার উল্টোটাও চিন্তা করি। আপনি খুব সচেতন মানুষ। যাকে তাকে সহজে বিশ্বাস করেন না, সব কিছু যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেন। এমন যদি হয়, তাহলে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও কি আপনি একই রকম যাচাই বাছাই করবেন না?
অর্থ্যাৎ, আপনার নিজস্ব জীবন-যাপন, ধ্যান-ধারণা, পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস স্বাভাবিকভাবে আপনার ভোগ বিলাসে প্রতিফলিত হবে।

এই যুক্তির ওপর ভর করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন – ব্যক্তিজীবনে আপনি যদি মনোগামি হন, মাত্র একজন সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন, তবে খুব সম্ভাবনা আছে আপনি আপনার পছন্দের ব্র্যান্ডের প্রতি লয়্যাল হবেন।

বর্তমান সময়ের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো ভেঙে যাচ্ছে নিমিষেই; ডিভোর্স আর পরকীয়া বাড়ছে। বাংলা নাটকে কৈশোর উত্তীর্ণ নায়ক নায়িকা প্রতি ৫ মিনিটে ১১বার একে অন্যকে বলছে ‘তোমার সাথে আমার রিলেশন নাই, রিলেশন শেষ’। পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের তীব্র অভাব। শুধু তা-ই নয়, মানুষের মধ্যে এখন খুব দ্রুত কর্মক্ষেত্র পাল্টানোর প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। একটু বাড়তি সুযোগ, বেশি বেতন, প্রমোশন; ইত্যাদির সুযোগ পেলেই কর্মীরা পল্টি খাচ্ছে। মানে কর্মক্ষেত্রের প্রতিও লয়্যালটি কম।

ব্যাপারটা এরকম যে রোমিওর শান্তিতে থাকার উপায় নেই। পুরনো প্রেমিকা ফেসবুকে নক করছে, হোয়াটস্যাপে মেসেজ দিচ্ছে; টিকটকে হাতছানি দিচ্ছে আরো দুই উদ্ভিন্না কিশোরী; ফলে রোমিও আর জুলিয়েটের প্রতি একনিষ্ঠ মনোযোগ রাখতে পারছে না। জুলিয়েটের সাথে সামান্য মনোমালিন্য হলেই সে কিউপিড ক্যাফেতে হেলেন কিংবা লাইলীর সঙ্গে কফি ডেট করছে। অন্যদিকে, জুলিয়েটও বিরহে শোকে কাতর হয়ে বিষপান করছে না। বরং এতোদিন অপেক্ষায় রাখা, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ঝুলিয়ে রাখা, মেসেজ আনসীন করে রাখা  মজনু-কাঞ্চন-মান্না-অনন্ত-জায়েদ আর শাকিবকে প্রশ্রয় দিয়ে লাস্য হাসিতে হাসছে।
ফলে, একালের রোমিও-জুলিয়েটরা একে অন্যের প্রতি বা কোনো ব্র্যান্ডের প্রতি লয়্যাল হচ্ছে না। এমনকী রোমিও-জুলিয়েটের বাবা-মায়েরা চাকরি পাল্টাচ্ছে একের পর এক। এই যে সুযোগের অবিরত সন্ধান, লাভ ও লোভের যে চর্চা; সেখানে পুরনো প্রশ্ন এবং উত্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে –
: “কাস্টমাররা আসলেই লয়্যাল নাকি সুবিধাবাদী?”
: "Customer loyalty is overrated."


খানে ইনটুইটিভলি একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে। এখনকার জেনারেশনকে যদি চিত্তচাঞ্চল্যে ভরপুর কাস্টমার সেগমেন্ট হিসাবে বিবেচনা করি, তাহলে তারা কি তুলনামূলকভাবে কম ব্র্যান্ড লয়্যাল? প্রাথমিক অনুমানে সেরকমই মনে হতে পারে। বিজ্ঞাপন বিষয়ক অন্যতম পত্রিকা অ্যাডএজের প্রতিবেদন সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তবে গবেষণার ফলাফল বলছে মিলেনিয়াল, মানে যাদের জন্ম ১৯৮১-১৯৯৯ সালের মধ্যে, তাদের মধ্যে লয়্যালটির প্রবণতা বেশ প্রকট।    



*
অর্থ্যাৎ, লয়্যালটি একেবারে উধাও হয়ে যায়নি।

এই লেখা যারা পড়ছেন তারা কেউ হয়তো কোকা-কোলার প্রতি লয়্যাল। তাদের বন্ধু পরিবার বা পরিচিত কেউ হয়তো ক্লোজ আপ টুথপেস্ট, হুইল সাবান, প্যারাসুট তেল, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, আইফোন, বাটা, বোম্বে চানাচুর বা হারপিকের প্রতি লয়্যাল।

এইসব লয়্যাল কাস্টমাররা কোম্পানীর জন্য সম্পদ। এ লেখার শুরুতেই জেনেছি লয়্যাল কাস্টমার কেবল নিজেই ব্র্যান্ডটি কেনে না, বরং অন্যদের ঐ ব্র্যান্ড কিনতে উৎসাহিত করে। ব্র্যান্ডের দিক থেকে এ যেনো লাভের ওপরে লাভ।

কজন পাকাপোক্ত লয়্যাল কাস্টমারকে খুব সহজে অন্য ব্র্যান্ড ভাগিয়ে নিতে পারে না। ধরি, কবির আহমেদ কোকা-কোলার লয়্যাল কাস্টমার। পেপসি মুখে নেন না। সেভেন আপ বা স্প্রাইটের গন্ধও সহ্য করতে পারেন না। এখন ভার্জিন কোলা এসে যদি কবির আহমেদকে বলে – স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন বলেছেন “কোকা-কোলার দিন শেষ, ভার্জিন কোলার বাংলাদেশ” – এটা শুনে কবির আহমেদ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতে পারেন। এমনকী ভার্জিন কোলার ক্যানের মধ্যে গোপনে কোকা-কোলা ঢেলে পরিবেশন করলেও তিনি তাতে তেলাপোকার গন্ধ পাবেন। ব্যাপারটা সাইকোলজিক্যাল।

বিশেষজ্ঞরা এ কারণে পরামর্শ দেন, কখনোই কাস্টমারের মাইন্ড চেইঞ্জ করতে যাবেন না; এটা বিপজ্জনক খেলা হতে পারে। সে কারণে, পাকাপোক্ত লয়্যাল কাস্টমারদের টানাটানি না করে “নিউ জেনারেশন কাস্টমার”দের দিকে নজর দিতে বলা হয়।

নিউ জেনারেশন কাস্টমারের বয়স কত?
মোটামুটি ১৩ বছর বয়সের মধ্যে শিশুরা কোনো না কোনো ব্র্যান্ডের ভক্ত হয়ে ওঠে। এই ১৩ বছর বয়সটা এক রকম মাইলস্টোন। উল্লেখ্য, অনেক কোম্পানী ১৩ বছরের কম বয়েসীদের কোনো মার্কেটিং ক্যাম্পেইনের টার্গেট করে না। ফেসবুকে একাউন্ট খুলতে গেলেও বয়স ন্যুনতম ১৩ হতে হয়।

শিশুরা মূলতঃ বাবা-মা’র পছন্দকেই তারা নিজেদের পছন্দ বলে মেনে নেয়। একটা বড়সড় কাস্টমার গ্রুপ তাদের বাবা-মায়ের ব্যবহার করা ডিটারজেন্ট পাউডার, টুথপেস্ট, তেল, গাড়ি কিংবা ব্যাংকের প্রতি লয়্যাল হয়ে যায়। তিব্বত কদুর তেলের বিজ্ঞাপনে যেমন আমরা দেখি শ্বাশুড়ি যত্ন করে বৌমার চুলে কদুর তেল মেখে দিচ্ছে আর বৌমা বলছে “আমার মা-ও তিব্বত কদুর তেল দিয়ে দিতেন, এজন্য সব সামলাতে পারি”। এই যে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ব্র্যান্ডের বিস্তার একে থিয়রিতে “ইন্টারজেনারেশনাল ব্র্যান্ড ট্রান্সফার” বলা হয়। অর্থ্যাৎ, আপনি যদি একটা জেনারেশনকে লয়্যাল কাস্টমার বানাতে পারেন, সম্ভাবনা আছে তাদের পরের জেনারেশনও আপনার ব্র্যান্ডের ভক্ত হবে।

উত্তরাধিকারসুত্রে কেউ ব্র্যান্ড লয়্যাল হবে কিনা সেটা অনিশ্চিত।
তবে, উত্তরাধিকারসুত্রে প্রাপ্ত অন্যতম বাস্তবতা হলো – ধর্ম।

চরাচর বাবা মা’র পালন করা ধর্মই মানুষের অটোমেটিক চয়েস হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা শৈশব থেকে ঘটে বলেই ধর্মের প্রতি বিশ্বাস এবং আনুগত্য শক্তপোক্ত হয়ে উঠে। যেহেতু অল্প বয়স থেকে এই বিশ্বাস শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, বড় হয়ে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) কেউ ধর্ম পালটায় না। স্বধর্মের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস এতো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে যে অন্য ধর্মের বয়ান কিংবা উপঢৌকন কিছুই স্পর্শ করে না। ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য সম্ভবতঃ ইহজগতে সবচে’ প্রাচীন এবং শক্তিশালী লয়্যালটি। ব্যাপারটা ‘বিশ্বাস’জনিত। ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের তর্কের সমাপ্তি ঘটে এই বিশ্বাস এবং যুক্তির দ্বিমুখী সড়কে।

ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচারের যে মডেল ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, সেটা অনুকরণ করে ব্যবসায়িক প্রচার প্রসার করা যায় কিনা সে চেষ্টা আগেই হয়েছে। আগ্রহী পাঠকরা ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের টিপিং পয়েন্ট বইটি পড়তে পারেন। সেখানে ম্যাভেন-কানেক্টর-সেলসম্যান এই তিন ধরণের মানুষের কথা বলা হয়েছে। ম্যাভেনরা জ্ঞানী; অনেক বিষয়ে খবর রাখে। কানেক্টরদের সামাজিক বিস্তৃতি ব্যাপক; এদের চেনাজানা লোকের সংখ্যা প্রচুর। অন্যদিকে সেলসম্যানরা বাকপটু। কোনো ব্যাপারে কাউকে বোঝানোয় তারা দক্ষ। ধর্ম প্রচার এবং মার্কেটিং-এ এই তিন ধরণের মানুষের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই।

ভোক্তারা ব্র্যান্ডের উপাসক

অ্যাকাডেমিক এবং প্র্যাকটিশনাররা ব্র্যান্ড উপাসনা নামক একটা ধারণার কথা বলেন। সে ধারণার মূল ফোকাস হচ্ছে, মানুষ যেমন ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখে, ঈশ্বরের বক্তব্যে আস্থা রাখে  - ঠিক তেমনি করে ব্র্যান্ডের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে, ব্র্যান্ডের ভ্যালু প্রপোজিশনে ‘অন্ধ বিশ্বাস’ রাখবে। 

থিয়রেটিক্যালি ব্র্যান্ড উপাসনার ব্যাখ্যা সহজ, কিন্তু প্রায়োগিক দিক থেকে খুব জটিল। তবে অসম্ভব নয়। অ্যাপেল ব্র্যান্ডের যে কম্যুনিটি গড়ে উঠেছে, সেখানে একটা কাস্টমার গ্রুপ আছে যারা অ্যাপলের সমস্ত বক্তব্যকে ঐশী বাণী বলে মেনে নেবে।


আবার শুরুর প্রশ্নে ফিরে যাই।
ব্যক্তিগত জীবনে আপনি যদি ধার্মিক হন, ঈশ্বরে অগাধ আস্থা রাখেন, তাহলে অন্যদের তুলনায় আপনার ব্র্যান্ড লয়্যাল হওয়ার সম্ভাবনা কি বেশি?

পরিসংখ্যান মতে বিশ্বের বর্তমান জনগোষ্ঠীর ৭ শতাংশ আজ্ঞেয়বাদী; ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে তরুণদের মাঝে, ধর্মহীন-ঈশ্বরহীন জীবনযাপনের প্রবণতা বাড়ছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই ধর্মহীনতার প্রভাব পড়ছে ব্র্যান্ড লয়্যালটির ওপর। যে জনগোষ্ঠী ঈশ্বরে আস্থা রাখে না, বিশ্বাসের মনোপলিতে নিজেকে সমর্পন করে না, ধর্মগ্রন্থগুলোর বাণীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; সে জনগোষ্ঠী খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্র্যান্ডের বক্তব্য-বিজ্ঞাপন-বাহারে বিশ্বাস স্থাপন করবে না।
   
অ্যাকাডেমিক রিসার্চে পরস্পর বিরোধী ফলাফল পাওয়া গেলেও গবেষকদের একাংশ মনে করেন – যারা ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক তারা অধার্মিকদের তুলনায় বেশি ব্র্যান্ড লয়্যাল হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা জেনেছি আপনার নিজস্ব জীবন-যাপন, ধ্যান-ধারণা, পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস স্বাভাবিকভাবে আপনার ভোগ বিলাসে প্রতিফলিত হবে। ঠিক তেমনি, যারা ঈশ্বরে তীব্র বিশ্বাসী, নিয়মিত ধর্মচর্চা করে, তারা পণ্য ও সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব বেশি সুইচ করে না। মানে, পছন্দের ব্র্যান্ডের প্রতি লয়্যাল হয়।

ব্র্যান্ড লয়্যালটি মারা যাচ্ছে কিনা – এ প্রশ্নের ধ্রুব কোনো উত্তর নেই। যে ব্র্যান্ড ভোক্তার সমস্যার সমাধান করতে পারবে, নিত্য নতুন ফিচার-বেনিফিট নিয়ে আসতে পারবে, এবং সর্বোপরি ইমোশনাল কানেকশন তৈরি করে ভোক্তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যেতে পারবে, সেই ব্র্যান্ডের প্রতি একটা বড়সড় মার্কেট সেগমেন্ট লয়্যাল হবেই হবে। ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবনে মনোগামি-পলিগামি-বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী কিনা সে প্রশ্ন তখন গৌণ হয়ে যাবে। 

উদাহরণ?

ফেসবুক, অ্যাপেল, অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স এবং গুগলের কথা ভেবে দেখুন। এই পঞ্চপান্ডবের (FAANG) লয়্যাল কাস্টমারের সংখ্যা নিয়ে কারো মনে দ্বিধা হয়তো নেই।   



তাই লয়্যালটি এখনো মরেনি।
কেবল, সময়ের সাথে সাথে ধরণ ও ভিত্তি পাল্টেছে। সামনে আরও পাল্টাবে। 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়াটাই ব্র্যান্ডের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

__

নোটঃ
ইনফোগ্রাফিক এখানে...

No comments:

Post a Comment