৪৫ বছর বয়েসী ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী নাম পাল্টাচ্ছে – সম্প্রতি এমন ঘোষণা দিয়েছে ইউনিলিভার।
ব্র্যান্ডের নাম পাল্টানো খুব অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের ইতিহাসের পাতায় এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। মালিকানা-ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের কারণে গত এক যুগে আমাদের চোখের সামনে একটেল হয়ে গেছে রবি, ওয়ারিদ হয়ে গেছে এয়ারটেল। ফারমার্স ব্যাংক নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক হয়েছে এই কয়েক বছর আগে।
বেলজিয়ামের চকলেট ব্র্যান্ড Isis নাম পালটে Libeert হয়েছে ২০১৪ সালে। সন্ত্রাসী সংগঠনের সংগে নাম মিলে যাওয়ায় বেশ বেকায়দায় পড়েছিল এই ব্র্যান্ড। করোনা সংকটে পড়ে Corona বিয়ারের সংকট পত্র পত্রিকায় এসেছে। তবে করোনা বিয়ার নাম পাল্টায়নি।
ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের নাম বা মালিকানা পাল্টায়নি। যদিও ১৫ বছর আগে অবশ্য লিভার ব্রাদার্স থেকে ইউনিলিভার হয়েছে। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর ‘ব্র্যান্ড পজিশনিং’-এ আহামারী কোনো ধাক্কা আসেনি যে নাম পাল্টাতে হবে। আমরা একটা ব্র্যান্ডের ইন্টারন্যাল এবং এক্সটারন্যাল এনভায়রনমেন্টের যে আলাপ করি, সেখানে ইন্টারন্যাল কোনো ফ্যাক্টরের দৃশ্যমান সংকট নেই। নাম পাল্টানোর এই চাপ একান্তই এক্সটারন্যাল।
চলতি সময়ে আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদ এবং বর্ণ বৈষম্য বিরোধী যে, “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার”, আন্দোলন চলছে, তার অংশ হিসেবে জনসন অ্যান্ড জনসন তাদের নিউট্রোজেনা এবং ক্লিন অ্যান্ড ক্লিয়ারের স্কিন লাইটেনিং লোশনগুলোকে বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। এরপর ইউনিলিভার ঘোষণা দিয়েছে নাম থেকে ফেয়ার শব্দটি বাদ দেয়া হবে। আরেক সূত্র অবশ্য বলছে সম্পূর্ণ নতুন নামে আসতে পারে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে যদি রিব্র্যান্ডিং বলা হয়, তবে এই রিব্র্যান্ডিং-এর মাত্রা কতোটুকু হবে সেটা দেখার বিষয়। ব্র্যান্ড এলিমেন্টের কোন কোন অংশগুলো পালটানো হবে সেটাও নজরে রাখার মতো। তবে, একটা বিষয় স্পষ্ট যে – ব্র্যান্ডের ভ্যালু প্রপোজিশন পালটানো হবে। ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম হিসেবে আর নিজেকে পরিচয় দেবে না।
গত দুই দশকে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে – এক সময় ব্র্যান্ডটি নিজেকে স্রেফ ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম হিসেবে প্রকাশ করতো।
“এখন আরও নতুন, আরও উন্নত” উচ্চারণে
বারবার ব্র্যান্ডটি বলেছে কীভাবে মাত্র ৬ থেকে ৮ সপ্তাহে ত্বকের রঙ কালো থেকে শ্যামলা
থেকে ফর্সা করে দেবে।
ত্বককে সাদা করার এই বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে প্রচার এবং প্রচারণা চলেছে অনেক। বিভিন্ন নারী সংগঠন এবং প্রেশার গ্রুপের দাবী ছিল – এরকম ফর্সা রঙের চাহিদা সৃষ্টিকারী বিজ্ঞাপন নারীদের জন্য হানিকর এবং অপমানজনক।
এরপরে অবশ্য ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী
ফর্সা রঙের ব্যাপারটিকে প্রাধান্য না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে ফোকাস করেছে।
বলেছে, মুখে সৌভাগ্যের চিহ্ন এঁকে দেয় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী।
দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর সাফল্য আকাশচুম্বী। ৪৫ বছর ধরে ব্র্যান্ডটি সুনির্দিষ্ট ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করে প্রতিযোগিতার শীর্ষে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের বাজারে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থান দূরত্বের বিচারে অনেক দূরে।
হাজার হাজার সমালোচনা সত্ত্বেও বাজারে সাধারণ ভোক্তা সমাজের কাছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর আবেদন অটুট। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী যারা ব্যবহার করেন, তারা বর্ণবাদ নিয়ে কতোটা জানেন-বুঝেন-ভাবেন-পাত্তা দেন সেটা মোটেও ব্র্যান্ডের সাফল্যকে প্রভাবিত করে না।
এখন ধরি, নাম থেকে ফেয়ার বাদ দিলো কিংবা নতুন কোনো নামে চলে এলো বাজারে। আগে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলাম - রিব্র্যান্ডিং-এর মাত্রা কতোটুকু হবে সেটা দেখার বিষয়।
পুরনো পণ্য নতুন মোড়কে, নতুন নামে বাজারে কতোটা নতুনভাবে আসবে? এতো বছরের পরিচিত হাল্কা গোলাপী রংটি কি একেবারে উধাও হয়ে যাবে? পালটে যাবে ব্র্যান্ডের টাইপোগ্রাফি?
দোকানে গিয়ে একজন ভোক্তা যখন ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী চাইবে, তখন দোকানী কী তুলে দেবে তার হাতে? নাম যখন পালটে যাবে, ভ্যালু প্রপোজিশনিংয়ে যখন ত্বক ফর্সা করার কথা থাকবে না, তখন ভোক্তা এবং ব্র্যান্ডের মাঝে সম্পর্কের ভিত্তি হবে কী?
বাজারের তাক থেকে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী নামটি হারিয়ে গেলে কি ভোক্তাদের মন-মগজ থেকে কি নামটি হারিয়ে যাবে? ৪৫ বছর বয়েসী ব্র্যান্ডটির অস্তিত্ব কি খুব দ্রুত মুছে ফেলা সম্ভব? পিজি হাসপাতাল কিংবা চিটাগাং কি মানুষের মন থেকে মুছবে কোনো দিন?
দীর্ঘদিনের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্র্যান্ড পজিশনিং, কাস্টমার বেইজ, তর্ক বিতর্ক সত্ত্বেও বাজারে শক্ত অবস্থানের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর এই নাম বদলানোর সিদ্ধান্ত নিশ্চয় হুট করে আসেনি। বোর্ড রুমে থিংক ট্যাঙ্কদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চয় এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল। যেহেতু, ভেতরকার খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো প্রকাশ্যে আসবে না, তাই ব্র্যান্ডটি আবারও “এখন আরও নতুন, আরও উন্নত” স্লোগানে নবযাত্রা শুরু করবে কীনা সেটি নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে না।
নতুন যাত্রায় সাফল্য ধরে রাখলে, প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না।
তবে, “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, নাম না পাল্টেও, নিজেদের ব্র্যান্ড ফিলোসফি কিছুটা ঝালাই করে নেয়া যেতো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে – Fair বলতে কি শুধু ফর্সা বোঝানো হয়? Fair শব্দের বহুবিদ অর্থের ওপর ভিত্তি করে ন্যায্যতা, শুভবোধ, সাম্যতা’র দিকগুলোর দিকে নজর দেয়া যেতো। বিশেষ করে নারীর অধিকারের সঙ্গে এই শব্দ এবং বোধগুলোর সম্পর্ক এবং সম্পৃক্ততা একেবারে দূর্বল নিশ্চয় নয়।
ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর বিরুদ্ধে প্রেশার গ্রুপের আন্দোলন, সমূহ পিটিশন সাইন, নিশ্চয় এতোটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে ব্র্যান্ডটিকে নাম পাল্টাতে বাধ্য হতে হয়েছে।
তবে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর এই নাম পাল্টানোর ঘটনা বিশ্বের মানবাধিকার ও বর্ণ বৈষম্যের বর্তমান অবস্থাকে রাতারাতি পালটে দেবে না। দীর্ঘমেয়াদেও কতোটা প্রভাব পড়বে সেটা প্রশ্নের বিষয়।
কালো চুল চাওয়া, ফর্সা ত্বক চাওয়া – মানুষের একান্তই নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। চুলের কলপ কিংবা ফেয়ারনেস ক্রিমের চাহিদা ছিল এবং থাকবে। এসবের সঙ্গে বর্ণবাদ জড়ানো কতোটা যৌক্তিক তা নিয়ে অ্যাকাডেমিক ডিবেট হতে পারে। তবে, বাজার পরিস্থিতি এবং ভোক্তা চাহিদাকে এড়ানো যাবে না।
ত্বকের রঙ পাল্টানোর পণ্যের নামের চেয়ে, মনের বোধ-বিবেচনা-বিবেকের পরিবর্তন বেশি প্রয়োজন। তাই প্রশ্ন থেকেই যায় – ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর নাম পরিবর্তন কি খুব বেশি প্রয়োজন?
পরিশিষ্ট –
১৯৯০’র দশকের শুরুর দিকে হেনোলাক্স
নামের ফেয়ারনেস ক্রিম বাংলাদেশের মার্কেটে খুব জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে ১৯৯৩-৯৬ সালের
দিকে রেডিও টিভিতে ব্র্যান্ডটির নিয়মিত বিজ্ঞাপন যেতো।
বাংলাদেশ বেতার ঢাকার বিজ্ঞাপন তরঙ্গে প্রতি রবিবার দুপুর আড়াইটায় বিজ্ঞাপন কন্ঠ নাজমুল হুসাইনের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় প্রচারিত হতো ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান “হেনোলাক্স সুরের পরশ”। অনুষ্ঠানটি এতোই জনপ্রিয় ছিল যে প্রতিসপ্তাহে হাজার খানেক শ্রোতাদের চিঠি যেতো অনুষ্ঠানের ঠিকানায়।
সেই ১৯৯৩-৯৬ সালেই নাজমুল হুসাইন হেনোলাক্সের রেডিও বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন –
“সুন্দর মনের মানুষই তো সুন্দর
কিন্তু, দেখতে সুন্দর হলে আরও ভালো!
সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলে কে?
হে-নো-লা-ক্স”
রঙ ফর্সার বিপরীতে সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলার দিকে নজর দিয়েছিল হেনোলাক্স।
ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেনোলাক্স টিকতে পারেনি। তবে হেনোলাক্স একটি উদাহরণ তৈরি করেছিল। ২৫ বছর পরে এসে উদারহণটিকে মনে পড়লো। নাজমুল হুসাইনের বোধ এবং বিবেচনা বিজ্ঞাপনের ভাষায় উঠে এসেছিল। আফসোস, সে বোধের বিস্তার বাংলাদেশের বাজারে ঘটেনি। ঘটলে, ২০২০ সালে এসে এখানে ফেয়ারনেস ক্রিমের পজিশনিং অন্যরকম হতে পারতো।
কালো চুল , ফর্সা ত্বক চাওয়া – মানুষের একান্তই নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। চুলের কলপ কিংবা ফেয়ারনেস ক্রিমের চাহিদা ছিল এবং থাকবে। এসবের সঙ্গে বর্ণবাদ জড়ানো যৌক্তিক না।
ReplyDelete"প্রশ্ন উঠতেই পারে – Fair বলতে কি
ReplyDeleteশুধু ফর্সা বোঝানো হয়? Fair শব্দের বহুবিদ অর্থের ওপর ভিত্তি করে ন্যায্যতা, শুভবোধ,
সাম্যতা’ - র দিকগুলোর দিকে নজর দেয়া যেতো। বিশেষ করে নারীর অধিকারের সঙ্গে এই শব্দ এবং
বোধগুলোর সম্পর্ক এবং সম্পৃক্ততা একেবারে দূর্বল নিশ্চয় নয়।" - দ্বিমত পোষন করছি।
গত ৪৫ বছরে ইউনিলিভারের এই ব্র্যান্ডটি তাদের পজিশনিং এমনভাবে করেছে, তাদের টিভিসি, ওভিসি, এটিএল বিটিএলে সব স্পষ্টভাবে মুখমন্ডলের রং ফর্সা করাকে সরাসরি তাদের ইউএসপি হিসেবে দাবী ও প্রমোট করা হয়েছে। এবং একটা করেছে একদম কনসিসটেন্টলি। এখন হুট করে যদি তারা দাবী করে বসে - “আমরা এতদিন ফেয়ার বলতে ফর্সা বুঝালেও আজ থেকে সাম্যতা বুঝাচ্ছি, এই কারণে নাম যা আছে তাই থাকবে।” - প্রতিস্ঠিত একটা ব্র্যান্ডের জন্য এটা নাম না বদলানোর একটা খুবই হাস্যকর অজুহাত হতো। অনন্ত, বেশীরভাগ ক্রেতারা তাই ভাবতেন যে নাম একই রাখার অজুহাত খোজাঁ হচ্ছে।
এখন নাম বদলানোর ফলে এই ব্র্যান্ড প্রেশার গ্রুপের প্রতি সন্মান দেখিয়েছে। কাষ্টমাররা এটাকে ভালো বৈ খারাপ ভাবে নেয়নি। আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক একটিভিষ্টকে এই রিব্র্যান্ডিংকে স্বাগত জানাতে দেখেছি। সাম্যতার দিকে গেলে আমি নিজেই হয়তো গাল দিতাম।