এয়ার এশিয়ার গল্পটা মূলতঃ টনি ফার্নান্দেজের।
এ গল্পের শুরু ২০০১ সালের ডিসেম্বরে।
যদিও এয়ার এশিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল আরো আগে – ১৯৯৬ সালে।
কীভাবে ‘মাত্র ১ রিঙ্গিতে’ ২০০১ সালে এয়ার এশিয়া টনির হাতে এলো, তারপর কী হলো, সেসব প্রসঙ্গ আসবে একটু পরে...।
কীভাবে ‘মাত্র ১ রিঙ্গিতে’ ২০০১ সালে এয়ার এশিয়া টনির হাতে এলো, তারপর কী হলো, সেসব প্রসঙ্গ আসবে একটু পরে...।
টনির জন্ম মালয়েশিয়ায়; বাবা ভারতীয় – মা মালয়েশিয়ান।
ইংল্যান্ডে পড়ালেখা করার সময় টনির বারবার মালয়েশিয়ায় বেড়াতে যেতে মন চাইতো।
কিন্তু, প্লেনের টিকিটের দাম দেখে সে ইচ্ছা দমে যেতো। সেই থেকে স্বপ্ন – যদি স্বল্প
মূল্যের এয়ারলাইন্স আকাশে উড়ানো যেতো!
লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসে অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়ালেখা শেষে রিচার্ড ব্র্যানসনের
ভার্জিন গ্রুপে বছর দুয়েক কাজ করেছিলেন টনি। এরপর যোগ দিয়েছিলেন ওয়ার্নার মিউজিকে।
ওয়ার্নার মিউজিক নিজেদের আমেরিকান অনলাইনের সঙ্গে একীভূত করলে চাকরি ছেড়ে দেন টনি। লক্ষ্য - অনেকদিনের স্বপ্ন বাজেট এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠার দিকে।
সাবেক বস রিচার্ড ব্র্যানসনের কোনো পরোক্ষ প্রভাব কি ছিল এ সিদ্ধান্তে?
অবশ্য এয়ার এশিয়ার সাথে ব্র্যানসনের খুব মজার এক কাহিনী আছে :)
নতুন এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠার অনুমতি চাইতে টনি গেলেন সে সময়কার মালয়েশিয়ান
প্রধান মন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের কাছে। মাহাথির দিলেন ভিন্ন প্রস্তাব – বললেন,
এয়ার এশিয়া কিনে নাও। সরকারের মালিকানাধীন এয়ার এশিয়া ১৯৯৬ সালের পর থেকেই
যাচ্ছেতাই অবস্থায় ছিল। লাভ দূরে থাক, ব্যাংক লোনের চাপে এয়ার এশিয়া মৃতপ্রায়
অবস্থায় ছিল। মাহাথিরের প্রস্তাব টনির পছন্দ হয়।
আরও কয়েকজন পার্টনার মিলে মাত্র ১ রিঙ্গিতে কিনে নেন এয়ার এশিয়া। তবে সঙ্গে নিতে
হয় ৪০ মিলিয়ন রিঙ্গিতের ঋণের ভার।
ঐতিহাসিক এক রিঙ্গিতের রশিদ হাতে টনি ও তার বিজনেস পার্টনার কামার |
২০০১ সাল – ভুল সময়?
২০০১ সালে যখন এয়ার এশিয়া নবযাত্রা শুরু করে তখন
মিডিয়ায় বলা হচ্ছিল সময়টা খুবই খারাপ। নাইন-ইলেভেন ঘটেছে মাত্র কিছুদিন আগে।
বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা নিয়ে কড়াকড়ি। আকাশ পথের যাত্রীদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমছে।
নামকরা এয়ারলাইন্সের ক্রাফট গ্রাউন্ডে বসে আছে, যাত্রী সংকট। অন্যদিকে কর্মী ছাটাই
চলছে হরদম; ঠিক এমন সময়ে এয়ার এশিয়া কোন সাহসে যাত্রা শুরু করে? তা-ও ৪০ মিলিয়ন
ঋণের ভার ডানায় রেখে? কেমন হবে এ নতুন যাত্রা?
টনির ব্যাখ্যা ছিল অবশ্য অন্যরকম।
তার মতে – এয়ার এশিয়া অন্য সব এয়ারলাইন্সের মতো নয়।
এটা বাজেট এয়ার। টিকিটের দাম কম। তবে খাবার কিনতে হবে আলাদা করে, লাগেজের ওজন
কিনতে হবে আলাদা করে, ইন-ফ্লাইট বিনোদন (ম্যুভি দেখা, গান শোনা) কিনতে হবে আলাদা
করে। এমনকী বালিশ-চাদর লাগলে, তার দামও দিতে হবে আলাদা করে।
টনির বিশ্বাস ছিল, মালয়েশিয়ার কাস্টমাররা কেবল বিমানে
উড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে চায়; এই বেসিক চাহিদা মেটালেই হবে। যার ইচ্ছা
সে বাড়তি খাবার, ওজন, বালিশ কিনে নেবে।
টনি আরও খেয়াল করেছিলেন – লোকজন এয়ারপোর্টে
ম্যাকডোনাল্ডস/কেএফসি খেয়ে প্লেনে উঠে ঘুম দেয়, কারো যদি নাটক সিনেমা দেখতে ইচ্ছে
করে তবে মোবাইল ডিভাইসেই দেখবে (উল্লেখ্য, ল্যাপটপের পাশাপাশি পরে আইপ্যাড,
নোটপ্যাড, স্মার্ট ফোন এসে ব্যাপারটা আরো সহজ করেছে)। এর বাইরে যার যতোটুকু দরকার
সে মোতাবেক লাগেজের ওজন কিনবে।
আরেকটা হিসাব বলছিল, মালয়েশিয়ার মাত্র ৬% মানুষ
প্লেনে চড়েছে। সুতরাং বিশাল এক জনগোষ্ঠীর আকাশ যাত্রার স্বপ্ন পূরণের জন্য বাজেট
এয়ার হতে পারে দারুণ এক সুযোগ। মাত্র দু’টি পুরনো প্লেন নিয়ে যাত্রা শুরু করতে
কষ্ট হয়নি এয়ার এশিয়ার। অন্যান্য এয়ার থেকে চাকরি হারানো একদল দক্ষ কর্মীকে নিয়োগ
করেছিল এয়ার এশিয়া।
ফলে ২০০১ এর সংকটকালীন সময়ে অন্য সব এয়ারলাইন্স যখন
ধাক্কা খাচ্ছে, তখন এয়ার এশিয়ার যাত্রী বাড়ছে হু হু করে। স্বল্প মূল্যের কারণে,
দেখা গেল এয়ার এশিয়ার প্রায় ৫০% যাত্রী জীবনে প্রথমবারের মতো প্লেনে চড়ার সুযোগ
পেয়েছে।
এয়ার এশিয়ার স্লোগান – Now everyone
can fly সত্যি হলো।
নবযাত্রার ১ম বছরের মধ্যেই এয়ার এশিয়া ব্রেক ইভেনে
পৌঁছালো। ২য় বছরেই লাভের মুখ দেখলো। বাড়লো ক্রাফটের সংখ্যা।
মাহাথির মোহাম্মদকে ধরাধরি করে টনি
থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ওপেন এয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করলো। এয়ার এশিয়া
উড়াল দিল – ব্যাংকক, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ম্যাকাউ, চায়না, ফিলিপাইন আর
কম্বোডিয়ায়। এসবই হলো ২০০৫ সালের মধ্যে। পরের বছর এয়ার এশিয়া ডানা মেললো ব্রুনেই
আর মিয়ানমারের পথে...।
দীর্ঘ যাত্রা পথের জন্য এয়ার এশিয়া এক্স নামের নতুন
ব্র্যান্ড এলো। এয়ার এশিয়া এবং এয়ার এশিয়া এক্স; দু’টি ব্র্যান্ডের জন্য আলাদা
ম্যানেজমেন্ট টিম এবং ব্র্যান্ডিং স্ট্র্যাটেজি রাখা হলো।
২০১৭ সালের এক হিসাবে মালয়েশিয়ার সীমানা পেরিয়ে এয়ার
এশিয়া ১৮ দেশের ১০৯ শহরে ২২৫ টি রুটে প্রায় ২৭৫টির বেশি এয়ার ক্রাফট নিয়ে সাঁই
সাঁই করে উড়ছে।
সে সময় এয়ার এশিয়ার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০
বিলিয়ন রিঙ্গিত। কেবল এয়ার এশিয়া নামের ব্র্যান্ড ভ্যালু ৫৩৫ মিলিয়ন আমেরিকান
ডলার।
ব্যবসা পরিধিরও বিস্তার ঘটেছে – এয়ার এশিয়া গ্রুপের
মালিকানায় এসেছে এয়ার এশিয়া এক্সপেডিয়া, এশিয়া এভিয়েশন সেন্টার অব এক্সেলেন্স,
এশিয়া এভিয়েশন ক্যাপিটাল, টি&কো কফি এবং বিগ পে।
২০০৮ সাল থেকে শুরু করে টানা ১১ বছর Skytrax World’s Best Low Cost Airlines অ্যাওয়ার্ড
পেয়েই চলেছে।
সাফল্যের রহস্য কী?
এক লাইনে বলতে গেলে – বইয়ের পাতায় আমরা যেটা “লো-কস্ট-লিডারশীপ”
পড়ি, এয়ার এশিয়া সেটাকে বাস্তবে প্রমাণ করে দেখিয়েছে। নিজেই হয়েছে লো কস্ট লিডারের
অন্যতম উদাহরণ। এর বাইরে মোটাদাগে সাফল্যের পেছনে ৩টি ব্যাপার উল্লেখ করা হয় –
১) তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার
২) দক্ষ-প্রশিক্ষিত-নিবেদিত কর্মী বাহিনী
৩) ভোক্তার চাহিদা বুঝতে পারা
ই-টিকিট, অনলাইন চেকসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এয়ার
এশিয়া অন্য অনেক ফুল-সার্ভিস ফ্লাইট থেকে এগিয়ে ছিল। এর নিজস্ব বেশ কিছু সফটওয়্যার
আছে, যেগুলো টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে কল সেন্টার পর্যন্ত সব যোগাযোগ সমন্বয় করে।
আগে কর্মী, পরে কাস্টমার
টনি ফার্নান্দেজ বিশ্বাস করেন – সন্তুষ্ট কাস্টমারের সন্তুষ্ট
কর্মীবাহিনী প্রয়োজন।
এয়ার এশিয়ায় ব্যাপক পরিমাণে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
আছে। উল্লেখ্য – কোনো ফ্লাইটের দরজা খোলার পর মাত্র ২৫ মিনিটেই সব যাত্রীকে সীটে
বসিয়ে উড়াল দেয়ার ব্যবস্থাপনাগত রেকর্ড আছে এয়ার এশিয়ার।
এয়ার এশিয়া বছরের বিভিন্ন সময়ে লোভনীয় প্রমোশনাল
ক্যাম্পেইন চালায়। এর অন্যতম হলো – ৫০ লাখ ফ্রি টিকিট। এর বাইরে নির্দিষ্ট রুটে
নামমাত্র মূল্যে ভ্রমণের সুযোগ তো আছেই।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কাস্টমার স্যাটিসফেকশনের দিকে সার্বিক্ষণিক নজর রাখে এয়ার এশিয়া। অনেক বড়সড় ক্রাইসিস সামাল দিয়েছে এয়ার এশিয়া। এজন্য কেউ কেউ বলে থাকে – ইউনাইটেড এয়ার লাইন্সের উচিত এয়ার এশিয়া থেকে শেখা।
তেমনি একটি উদাহরণ দিয়ে এই লেখা শেষ করছি –
QZ8501
২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর
যাওয়ার পথে বিধ্বস্ত হয় QZ8501।
১৬২ আরোহীর সবাই মারা যায়।
উল্লেখ্য সে বছর ৮ মার্চে হারিয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ান
এয়ারের MH370।
QZ8501 বিধ্বস্ত হওয়ার পরে চারদিকে শোকের মাতম। যাত্রীদের মনে ভয় শংকা। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন্স ব্র্যান্ডগুলো ইমেজ সংকটে পড়েছে।
তখন টনি ফার্নান্দেজ অন্য অনেক সিইও’র মতো বোর্ড রুমে
বসে থাকেননি। মিডিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন, ক্ষমা চেয়েছেন, শোক সমবেদনা জানিয়েছেন।
নিজে ব্যাক্তিগতভাবে ফোন করেছেন নিহত যাত্রীদের পরিবারের
সঙ্গে, স্বান্ত্বনা দিয়েছেন, ক্ষতিপূরণ দেয়ার ওয়াদা করেছেন।
এরপর চলে গেছে বিমান বন্দরের চেক ইন কাউন্টারে। ঐ শোক
ও আতঙ্কের সময়েও যারা এয়ার এশিয়ায় ফ্লাই করছিলো, তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সাহস
যুগিয়েছেন।
এয়ার এশিয়ার ওয়েব সাইট সাদাকালো করে দেয়া হয়েছিল।
পরের কয়েক মাস কোনো প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন চলেনি।
কাস্টমারের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এ জায়গায় এয়ার এশিয়া
অনেক স্মার্ট এবং এগিয়ে ছিল। ফলে, কাস্টমারের আস্থা-বিশ্বাস ও ভালোবাসা ফিরে পেতে
দেরী হয়নি।
।
।
।
প্রাসঙ্গিক সূত্রঃ
https://coolerinsights.com/2017/07/crisis-communications-lessons-airlines/
https://goodyfeed.com/10-facts-about-air-asia-you-probably-didnt-know-of/
https://www.ukessays.com/essays/commerce/history-of-air-asia-commerce-essay.php
।
।
প্রাসঙ্গিক সূত্রঃ
https://coolerinsights.com/2017/07/crisis-communications-lessons-airlines/
https://goodyfeed.com/10-facts-about-air-asia-you-probably-didnt-know-of/
https://www.ukessays.com/essays/commerce/history-of-air-asia-commerce-essay.php
অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন একটি লেখা শেয়ার করার জন্য। খুব ভাল লেগেছে এই ওয়েবসাইটটি। অনেক কিছু জানতে পারবো আশা করছি।
ReplyDelete