New Coke: কোকা-কোলার মারাত্মক ভুল




২৩ এপ্রিল, ১৯৮৫।
কোকা-কোলা কোম্পানী তাদের তুমুল জনপ্রিয় কোমল পানীয় ‘কোকা-কোলা’কে বাতিল ঘোষণা করে। বাজারে আসে নতুন ফর্মুলায়, নতুন স্বাদে, নতুন ব্র্যান্ড ‘নিউ কোক’।
কোকা-কোলার ইতিহাসে এই ‘নিউ কোক’ এক ব্যর্থতার অধ্যায়।
কেন এই ব্যর্থতা? কী ছিল এর পেছনের গল্প?

প্রথম প্রশ্ন – কী এমন ঘটলো যে ‘কোকা-কোলা’র নাম পালটে ‘নিউ কোক’ বাজারে আনতে হলো? 

১৯৮৫ পূর্ববর্তী কোমল-পানীয়ের বিশ্ববাজারে কোকাকোলা এবং পেপসি কোলা দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
তারিখের হিসাবে পেপসির (১৮৯৮) এক যুগ আগে কোকা-কোলা (১৮৮৬) বাজারে এসেছে।
ভোক্তাদের কাছে কোলা মানেই কোকা-কোলা অথবা পেপসি কোলা।
পেপসির বাড়ন্ত জনপ্রিয়তা নিয়ে কোকা-কোলা এক পর্যায়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল।
পেপসি কেন নামের শেষে ‘কোলা’ ব্যবহার করবে? পেপসির সেই অধিকার আছে কিনা – এই মর্মে মামলা ঠুকে দিয়েছিল কোকা-কোলা। অবশ্য কোকা-কোলার অভিযোগ খারিজ হয়ে গিয়েছিল আদালতে।

আদালতে হারলেও বাজারে কোকা-কোলার অদম্য দাপট। ১৯৫০ সালে কোকা-কোলার বিক্রি ছিল পেপসির পাঁচগুণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোকা-কোলার এই জয়জয়কার অবস্থাকে “peaceful near-conquest of the world” উল্লেখ করে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে সাপ্তাহিক টাইমস।
 
টাইমসের প্রচ্ছদে কোকা-কোলা


পেপসি কী করেছিল?
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ১৯৬০ সালে রিপজিশনিং-এ পেপসি নিজেকে ‘তারুণ্যের ব্র্যান্ড’ হিসেবে পরিচয় দেয়। এই রিপজিশনিং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

পেপসি তরুণদের ব্র্যান্ড; তাহলে বয়স্কেরা কি পেপসিতে চুমুক দেবে না? পেপসি কি তাদের জন্য নয়? এই প্রশ্ন বাজার বিশেষজ্ঞদের চায়ের কাপে ঝড় তুললো। কিন্তু, বেচা-বিক্রির হিসাবে দেখা গেল – মার্কেট সেগমেন্টকে ন্যারো ডাউন করে কেবল তরুণদের টার্গেট করা পেপসি বেশ জনপ্রিয়তা পেলো বাজারে। এই জনপ্রিয়তা এবং বাজার দখলের গ্রাফ উর্ধ্বমূখী ছিল টানা দশ বছর।

‘The real thing’ স্লোগানের কোকা-কোলার বাজার চলে যাচ্ছে ‘The drink of youth’ পেপসির পকেটে।
এরপর ১৯৭৫ সালে পেপসি আরেক চমক দেখায়। Pepsi Challenge নামের ক্যাম্পেইনে তারা কোক পেপসির ব্লাইন্ড টেস্ট অফার করে প্রকাশ্যে। দেখা গেলো – ব্লাইন্ড টেস্টে অংশ নেয়া অধিকাংশ ভোক্তার কাছে ‘খানিকটা মিষ্টি স্বাদের’ পেপসিই বেশি পছন্দ হলো।

পেপসির ব্লাইন্ড টেস্টের বিজ্ঞাপন -




১৯৮০ সালের দিকে পেপসির মার্কেটিং আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। “পেপসি জেনারেশন” নামের ক্যাম্পেইনে ডন জনসন আর মাইকেল জ্যাকসনের মতো জনপ্রিয় তারকারা পেপসির মডেল হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে পেপসির জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে থাকে।

১৯৮৩ সালে কোকা-কোলার #১ অবস্থান হুমকির মুখে পড়ে গেল।
প্রথমবারের মতো কোকা-কোলার মার্কেট শেয়ার ২৪%-এর নিচে নেমে গেল। পেপসির আধিপত্যের বাইরে কোকা-কোলার এই পতনের পেছনে আরও দু’টি কারণ ছিল –

একস্প্রাইট ও ফানটা’র জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। কিন্তু, এই দুই ব্র্যান্ড নতুন কাস্টমার না ধরে কোকা-কোলার কাস্টমারদের পকেটে পুরে নিচ্ছিলো। বইয়ের ভাষায় যাকে বলে ক্যানিবালাইজেশন।

দুই ডায়েট কোকের উত্থান ঘটলো বাজারে। উল্লেখ্য, এক বছর আগেই, ১৯৮২ সালে, বাজারে চিনিমুক্ত ডায়েট কোক এসেছে। কোকা-কোলার কাস্টমারদের বড়সড় অংশ ডায়েট কোকে অভ্যস্ত হলো। আবারও ক্যানিবালাইজেশন। ডায়েট কোকের বেচা-বিক্রি এতো বেশি হলো যে দুই বছরের কম সময়ে কোমল পানীয়ের বাজারে ডায়েট কোক চলে এলো ৩য় স্থানে। এই ডায়েট কোক যেন কোকা-কোলা কোম্পানীর জন্য এক শাঁখের করাত...।
সব মিলিয়ে কোকা-কোলার নাম্বার ওয়ান অবস্থান নড়বড়ে।  

কোকা-কোলা বাস্তবতাকে অস্বীকার করেনি। পেপসির চেয়ে কোকা-কোলায় চিনি কম, এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ক্যাম্পেইনে নামলো কোক। সে সময়কার টেলিভিশনের সবচে চেনা মুখ বিল কসবিকে মডেল করা হলো বিজ্ঞাপনে –

 
প্রফিট লাইনে খুব বেশি প্রভাব ফেললো না এই বিজ্ঞাপন। বাজার দৌড়ে কোকা-কোলার ঘাঁড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছিল পেপসি। এরপরেও কোকের বাড়তি জোর যা ছিল তা হলো – ডিস্ট্রিবিউশন। সুপারমার্কেট আর ভেন্ডিং মেশিনে কোকের ডিস্ট্রিবিউশনের কাছাকাছি যেতে পারেনি পেপসি।

একটা বিষয় পরিস্কার – পেপসির স্বাদের কাছে হেরে গেছে কোকা-কোলা
এবার কেবল #১ অবস্থান হারানোর অপেক্ষা।
কী করবে কোকা-কোলা?

কোকা-কোলার বোর্ডরুমে থিংকট্যাঙ্কদের চুলচেরা বিশ্লেষণ, বাজার পরিস্থিতি আর ভোক্তার আচরণ পর্যবেক্ষণ। সবাই একমত – কোকের মার্কেটিং-এ সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ‘স্বাদ’-এ। কোকের চেয়ে পেপসির স্বাদ বেশি; এটাই মূল সমস্যা। বাজার জরিপে এমনও জানা গেল যে মূল কোকের চেয়ে ডায়েট কোকের স্বাদ বেশি মানুষ পছন্দ করছে। কেউ কেউ এমনও বলছে যে ডায়েট কোকের স্বাদ অনেকটা পেপসির কাছাকাছি!

সিদ্ধান্ত নেয়া হলো – কোকা-কোলার ফর্মুলা পালটানো হবে।
নতুন স্বাদের নতুন কোকের কর্মযজ্ঞ চললো ল্যাবে।

১৯৮৪ সালে তৈরি হলো নতুন কোক। বাজারে ছাড়ার আগে প্রায় ২ লাখ কাস্টমারের কাছে ‘টেস্ট মার্কেটিং’ করলো। ফলাফলে উঠে এলো – এই নতুন কোক কেবল আগের কোকের চেয়ে স্বাদু নয়, বরং পেপসির চেয়েও ভালো। অভাবিত এই ফলাফলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো খুব দ্রুত নতুন কোক বাজারে ছাড়া হবে।

কিন্তু, প্রশ্ন উঠলো – পুরনো কোক কি বাজারে থাকবে? নতুন-পুরনো এই দুই কোকের উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ কি চলবে? এতে কি ভোক্তারা বিভ্রান্ত হবে না? দুই ব্র্যান্ডের যুগপৎ দেখভাল কি সমস্যা হবে না?
ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো – বাজারে নতুন কোক আসবে এবং পুরনো কোক থাকবে না। পুরনো কোকের মৃত্যু ঘোষণা করা হলো।


New Coke
১৯৮৫ সালের ২৩ এপ্রিলে ‘নিউ কোক’ বাজারে ছাড়ার পরে কিছু ক্ষেত্রে বিক্রি বাড়ার সুসংবাদ এলো। তবে বৃহৎ পরিসরে ভোক্তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। এই নতুন কোকের নাম, প্যাকেজিং, স্বাদ কোনো কিছুই বৃহৎ ভোক্তাসমাজের মনমতো হলো না। বরং তারা নতুন কোকের বদলে দোকানে দোকানে “অরিজিনাল কোকের” সন্ধান করতে লাগলো। বাজারে পুরনো কোক নেই, কারণ – ফ্যাক্টরিতে পুরনো কোকের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

কোকা-কোলার হেড কোয়ার্টারে চিঠির বস্তা আর অবিরাম ফোন কল এলো (সংখ্যায় ৪০ হাজারের ওপরে)। সবার এক অভিযোগ – নতুন কোক ফালতু, পুরনো কোক ফেরত চাই।

ভোক্তাদের ক্ষোভের বিস্ফোরণের এরকম নজির মার্কেটিং-এর ইতিহাসে খুব বেশি নেই।

দোকানের তাকে নিউ কোক পড়ে থাকলো প্রত্যাখাত, অবাঞ্চিত এবং অপছন্দের পণ্য হিসেবে।

এরকম অবস্থা চললো – মাস তিনেকের মতো। কোকা-কোলার হর্তাকর্তারা বুঝলেন, নিউ কোক ব্যর্থ। জুলাই মাসের ১১ তারিখে ঘোষণা এলো – নিউ কোক বাজার থেকে উঠিয়ে “অরিজিনাল কোক” ফিরিয়ে আনা হবে।
কোকা-কোলা অবশ্য এই সিদ্ধান্তকে একটু নাটুকেপনায় বললো ‘We have heard you’ – আপনাদের মতামতের ভিত্তিতেই বাজারে ফিরছে পুরনো কোক।


সমস্যা কোথায়?
এটা একটা ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন যে – লোকজন পুরনো কোক পছন্দ করেনি। তাই, নতুন কোক বাজারে এলো। কিন্তু, নতুন কোক আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো কোকের খোঁজ পড়লো কেন? এর পেছনের রহস্য কী?

কোকা-কোলার সবচে’ বড় ভুল হচ্ছে – পেপসির সঙ্গে বাজার দখলের লড়াইয়ে কোক কেবল স্বাদের দিকে নজর দিয়েছে। স্বাদ বদলে নতুন কোক আনতে গিয়ে পুরনো কোকের শক্তি – ব্র্যান্ড পাওয়ার’কে তুচ্ছ করেছে কোকা-কোলা।

ব্র্যান্ড পাওয়ার মানে কী? এ কেমন শক্তি।
এই শক্তি ব্র্যান্ডের সাথে ভোক্তার সম্পর্কের, ঘনিষ্ঠতার, আবেগের শক্তি। এ কথা ঠিক যে, পেপসির সাথে দৌড়ে কোক মার খাচ্ছিল। কিন্তু, প্রায় শত বছর ধরে বাজারে থাকা, চোখে দেখা কোকা-কোলা হঠাৎ করে নিউ কোক হয়ে গেল; এটা মানুষ মেনে নিতে পারেনি।
মেনে না নেয়ার এই বাস্তবতা মনস্তাত্বিক। কোকা-কোলার প্রতি মানুষের ভালোবাসা, আবেগ এবং ঘনিষ্ঠতা ডলারের অংকে মাপা যাবে না। 

দুই লাখ মানুষের ওপর টেস্ট মার্কেটিং চালানো হয়েছে, তার ফলাফল হয়তো অবাস্তব নয়। নিউ কোকের স্বাদ হয়তো আসলেই ভালো ছিল। কিন্তু, মুশকিল হয়ে গেছে নামকরণে। নতুন নাম, নতুন মোড়কীকরণে কোকা-কোলার ব্র্যান্ডের শক্তি “অরিজিনালিটি”ই হারিয়ে গিয়েছিল। ক্যান খুলে জিহবায় নিউ কোকের স্বাদ নেয়ার আগ্রহ জাগেনি মানুষের মনে। তাদের সবচে’ বড় অভিযোগ ছিলো – এই কোককে আমরা চিনি না, এই কোক আমাদের এতো বছরের চেনা কোক নয়। আমরা আমাদের পুরনো কোক ফেরত চাই।


অরিজিনালিটি কেন কোকের শক্তি?
১৮৮৬ সালে জন্মের পর কোকা-কোলা বাজারে কেবল নতুন পণ্য আনেনি, এবং নতুন এক ক্যাটেগরির জন্ম দিয়েছে। কোমল পানীয়ের ইতিহাসে কোকা-কোলা হলো যাবতীয় ‘কোলা’ পণ্যের স্রষ্টা। ফলে, কোকা-কোলার এই লিডারশীপ, আদি এবং অকৃত্রিম সত্ত্বার বিস্তার প্রচারিত এবং প্রতিফলিত হয়েছে কোকা-কোলার বিজ্ঞাপনে। ১৯৪২ সালেই কোকা-কোলার বিজ্ঞাপন ছিল ‘The only thing like Coca-Cola is Coca-Cola itself. It’s the real thing.’

১৯৪২ সালের বিজ্ঞাপনে The real thing

এমনকী পেপসি যেখানে কয়েক বছর পরপর লোগো আপডেট করেছে, সেখানে কোকা-কোলার লোগো ছিল অপরিবর্তিত। অর্থ্যাৎ, কোকের সার্বিক মার্কেটিং কম্যুনিকেশনে একটা “আদি ও অকৃত্রিম” ভাব ছিল। শত বছরের প্রান্তে পোঁছে ১৯৮৫ সালে কোকা-কোলা যখন নিউ কোক আনলো, সেটা একদিকে যেমন ব্র্যান্ডের অতীত-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিললো না, তেমনি কাস্টমারদের পারসেপশনের সঙ্গেও খাপ খেলো না।

কেউ কেউ এমনও মন্তব্য করলো যে, কোকা-কোলা কেবল একটা পণ্য নয়, কোকা-কোলা আমেরিকান সিম্বল। নিউ কোকের কারণে এই আমেরিকান সিম্বলটাই পালটে গেল!

সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে এমন কথাও এলো যে, কোক মোটেও নতুন কিছু নয়। বরং, পেপসিই নতুন; কারণ পেপসি নতুন প্রজন্মকে টার্গেট করছে।

মার্কেটিং গুরুরা এমনও বলছেন – এই নতুন কোক সর্বোপরি ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করেছে। দশকের পর দশক ধরে যে ব্র্যান্ড বলছে Real thing, সেই ব্র্যান্ড হঠাৎ করে new হতে গেল কেন?
এতোদিন ধরে আপনারা নিজেদের বলছেন ‘অরিজিনাল’ এখন বলছেন ‘নতুন’। তাহলে, এই দুই বক্তব্য কি স্ববিরোধী নয়? তাহলে কি কোক কোনো ভুল স্বীকার করছে?

ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করার প্রসঙ্গে ব্র্যান্ডিং গুরু আল রাইজ এবং জ্যাক ট্রাউট বলেন – কখনোই ভোক্তার মন পাল্টাতে যাবেন না। এটা হবে অনেকটা ভোক্তার কাছে নতুন ঈশ্বর হাজির করার মতো। কেউ যদি জন্ম থেকে এক ঈশ্বরের উপাসনা করে – বিশ্বাস স্থাপন করে, আপনি যদি তাকে ‘নতুন ঈশ্বরে দীক্ষা’ নিতে বলেন – তবে সম্ভাবনা আছে আপনি কেবল তার মন পাল্টাতে যাচ্ছেন না, বরং তাকে বিভ্রান্ত করছেন। দীর্ঘদিন ধরে (কোকাকোলা কিংবা ঈশ্বরের প্রতি) তার যে বিশ্বাস এবং আশ্বাস গড়ে উঠেছে, আপনি সেখানে আঘাত করেছেন। এই আঘাত সে মেনে নেবে না। বরং আপনার কাজ এবং কথার প্রতি তার অবিশ্বাস তৈরি হবে। আপনাকে অগ্রাহ্য করবে।

ঠিক এমনটিই ঘটেছে নিউ কোকের ক্ষেত্রে। এতোদিনের গড়ে ওঠা ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্টকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে নিউ কোক প্রকল্প।

কনজ্যুমার-ব্র্যান্ড কানেকশনের পুরো ব্যাপারটিই মিস করে গেছে কোকের নীতি নির্ধারকরা।

নিউ কোক বাজারে আনা যে কোকা-কোলার ভুল ছিল সেটা বুঝতে পেপসির দেরী হয়নি। নিউ কোক বাজারে আসার কয়েক সপ্তার মধ্যেই পেপসি নতুন এক বিজ্ঞাপন টিভিতে ছাড়লো। বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে – পার্কের বেঞ্চিতে বসা এক বৃদ্ধ খুব ক্ষুব্ধ They changed my Coke– তখন পাশ থেকে আরেক বৃদ্ধ তার হাতে পেপসি তুলে দিচ্ছে।



 এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে “নিউ জেনারেশন” ট্যাগঅলা পেপসি বয়স্ক সেগমেন্টকেও টার্গেট মার্কেট বানিয়ে নিলো।


ওল্ড কোক, রিয়েল কোক, ক্লাসিক কোক
আগেই বলেছি, ১১ জুলাইতে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল পুরনো কোক ফিরে আসবে। এখন প্রশ্ন উঠলো – পুরনো কোকের নাম কী হবে? “নিউ কোক” ব্যর্থ, তাহলে পুরনো কোককে কি ওল্ড কোক বলা হবে? নাকি রিয়েল কোক? বা ওরিজিনাল কোক?
সিদ্ধান্ত হলো – নাম রাখা হবে “ক্লাসিক কোক”।

ক্লাসিক কোক বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়লো। মিডিয়া এতোদিন নিউ কোকের ব্যর্থতা প্রচার করেছে, তারা এবার ক্লাসিক কোকের কী অবস্থা সেটা নিয়ে নিত্য খবর জানাচ্ছিল।
ফলাফল?
কয়েক মাসের মধ্যেই ক্লাসিক কোক বাজার দখল করে নিলো। কোক আবার হয়ে উঠলো আমেরিকার #১ কোমল পানীয়।

কোকাকোলা থেকে নিউ কোক থেকে কোকাকোলা ক্লাসিক


ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
পেপসির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে বাজারে নিউ কোক এলো, নিউ কোক ব্যর্থ হলো। এরপর তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে তীব্র ঝড় ঝাপ্টার মধ্যে ক্লাসিক কোক এলো। আবার কোক নাম্বার ওয়ান হলো। একদল পর্যবেক্ষক এ সব কিছুকে কনস্পিরেসি থিওরিতে ফেললো। বললো, নিউ কোক আনাটাই ছিল কোম্পানীর এক রকম চালবাজি। তারা ইচ্ছা করে এমন করেছে। তারা জানতো নিউ কোক বাজার পাবে না, বরং এই নিয়ে বাজারে হৈ চৈ হবে। কাস্টমারের আবেগকে পুঁজি করে তাই বাজারে ক্লাসিক কোক ছাড়া হলো। এসবই পরিকল্পিত খেলা।

কোকা-কোলা কর্তৃপক্ষ এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে অস্বীকার করলো। বললো, নিউ কোক বাজারে আনা, তুলে ফেলা, আবার ক্লাসিক কোক আনা; এসবই বাস্তবতার নিরিখে আমাদের প্রতিক্রিয়া। বিশ্বের সেরা একটা ব্র্যান্ড নিয়ে নাটুকে ঝুঁকি নেয়ার সাধ্য আমাদের ছিল না। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাতকারে কোকের চিফ অপারেটিং অফিসার ডোনাল্ড বলেই ফেললেন – ‘The truth is we are not that dumb, and we are not that smart.’



পেপসির সেসময়কার সিইও রজার এনরিকো পরে একটা বই লিখেছিলেন “দ্য আদার গাই ব্লিঙ্কড”, যেখানে তিনি লিখেন – ফ্ল্যাগশীপ ব্র্যান্ডের স্বাদ পরিবর্তন করা কোকা-কোলার মোটেও উচিত হয়নি। একটা ব্র্যান্ডের ইমেজ প্রতিষ্ঠা হতে অনেক বছর লাগে। ১৯৮৫ সালে নিউ কোক বাজারে এনে কোকা-কোলা এতদিনের অর্জিত ইমেজ, হেরিটেজ, ব্র্যান্ড পাওয়ার সব পানিতে ফেলে দিচ্ছিলো...


ভুলের পরে...
নিউ কোক আনাকে বলা হচ্ছে মার্কেটিং ইতিহাসের বড় ভুলগুলোর একটি।
কিন্তু এই ভুল থেকে শিক্ষা কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন –

১) ব্র্যান্ডের যুদ্ধটা প্রোডাক্ট নিয়ে নয়, পারসেপশন (উপলব্ধি) নিয়ে। আপনার ব্র্যান্ড বিষয়ে ভোক্তাদের পারসেপশন কী, সেখানে মনোযোগ দিন। হুট করে পারসেপশন পাল্টাতে যাবেন না।

২) প্রতিযোগীকে অনুকরণ করতে যাবেন না। ব্র্যান্ডগুলোর ভ্যালু প্রপোজিশন আলাদা। কেউ স্বাদ নিয়ে আসবে, কেউ কম দাম নিয়ে আসবে, কেউ বিপনন নিয়ে আসবে, কেউ কাস্টমার সার্ভিস নিয়ে আসবে। অন্যেরা কী করলো সেদিকে নয়, আপনার শ্রেষ্ঠত্ব কোথায় – আপনি কী দিয়ে ভোক্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারবেন, কী দিয়ে প্রতিযোগীকে হারাতে পারবেন; সেটা ভাবুন।

৩) ট্রেডমার্ক নয়, এখন লাভমার্কের দুনিয়া। ভোক্তার সঙ্গে ব্র্যান্ডের ইমোশন্যাল অ্যাটাচমেন্ট তৈরির বিকল্প নেই। ইমোশন্যাল অ্যাটাচমেন্ট তৈরি করতে পারলে – ভোক্তারা লয়্যাল হবে, পজিটিভ ওয়ার্ড অব মাউথ প্রচার করবে।

৪) সঠিক বিষয়ে মার্কেট রিসার্চ করুন। নিউ কোকের স্বাদ নিয়ে ২ লাখ মানুষকে জিজ্ঞেস করেছেন, কিন্তু নতুন নাম – প্যাকেজিং নিয়ে কিছু জানতে চেয়েছেন কী? কাস্টমারের পারসেপশনকে অগ্রাহ্য করবেন না।

৫) সময়মতো ইউ টার্ন নিতে দ্বিধা করবেন না। নিউ কোক ব্যর্থ হচ্ছিল, ৩ মাসের কম সময়ে কোকা-কোলা ক্লাসিক কোক নিয়ে এসেছে, সফল হয়েছে।

*
আগ্রহীরা থমাস অলিভারের লেখা The real coke, the real story বইটি পড়তে পারেন -



***

আরও পড়তে পারেন –






3 comments:

  1. This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. আর্টিকেল টা আরো অনেক ইন্টারেস্টিং হইতে পারতো, বোরিং লেখা

    ReplyDelete