বাজারজুড়ে
অফুরান অফার।
মনোপলি
বলতে আর কিছুই থাকছে না।
খাবারের কথাই ধরি। আদিম সমাজে অপশন খুব বেশি ছিল না।
যেদিন মুরগী শিকার হতো, সে রাতে খাবার ছিল মুরগীই। অন্যদিন হয়তো
খরগোশ।
এখন শিকারের চ্যালেঞ্জ নেই। বরং, সামর্থ্য থাকলে,
“কী খাবো” সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে।
মুরগী পছন্দ? ডিনারে কী খাবেন? চিকেন ফ্রাই, চিকেন কারি, চিকেন
রেজালা, চিকেন ব্রোস্ট, চিকেন বল,
চিকেন রোস্ট, চিকেন কাবাব, চিকেন স্যুপ, চিকেন বিরিয়ানি, চিকেন
বার্বিকিউ, চিকেন চাপ নাকি দেশি মুরগীর ঝোল?
দেশি’র
সাথে বিদেশিও যুক্ত হয়। কোন স্টাইল? থাই চিকেন, ইন্ডিয়ান চিকেন, কোরিয়ান নাকি
কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন?
শুধু
কি খাবার? ভোগ তথা কনজাম্পশনের সর্বত্র অপশনের বিস্ফোরণ!
বিনোদন
– বিটিভির মনোপলি শেষ হয়েছে অনেক আগে। রিমোট টিপলে দুইশ’ চ্যানেল। ইন্টারনেটের
কল্যাণে নেটফ্লিক্স, হুলু। হাতের মুঠোফোনে লাইভ স্ট্রিমিং, ইউটিউবে হাজার হাজার
চ্যানেল; কী দেখবো, কোনটা দেখবো সেটা ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যায়।
সকালে
দৈনিক পত্রিকায় তরতাজা খবর বলতে আর কিছু থাকছে না। গতরাতে অনলাইনে পড়া খবরগুলো বাসি
খাবারের মতো বিক্রি হচ্ছে নিউজপ্রিন্টে। দেশে
প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা নাকি হাজারের ওপরে।
যে
ইন্টারনেট জগতকে হাতের মুঠোয় এনেছে – সে ইন্টারনেট সেবারও ডজন ডজন অপশন। ডায়াল আপ
বিগত হয়েছে। ব্রডব্যান্ড, ওয়াই ফাই, মোবাইল ডাটা; সর্বত্র প্যাকেজের সমাহার। কোনটা
ভালো কোনটা মন্দ? মাথা চুলকায়। বাজারে কাপড় কাঁচার সাবান কিনতেও এতো কনফিউজড হতে
হয় না।
সামর্থ্য
বাড়ার সাথে সাথে সব কিছুর অপশন বেড়ে যায়। ভোগের মতো ভোগান্তিরও অনেক অপশন। হার্ট
সার্জারি কোথায় করাবেন – অ্যাপলো, স্কয়ার, ইউনাইটেড, আসগর আলি, হার্ট ফাউন্ডেশন,
ইবনে সিনা, ল্যাব এইড, নাকি শহরের গলির মোড়ে মোড়ে থাকা আরো সহস্র হাসপাতালের কোনো
একটিতে? নাকি বিদেশ ভালো? মাদ্রাজ, চেন্নাই, কোলকাতা, দিল্লী, সিংগাপুর ন্যাশনাল
নাকি মাউন্ট এলিজাবেথ? নাকি থাইল্যান্ড? কোনটা ভালো – বামরুনগ্রাদ নাকি ব্যাংকক
ইন্টারন্যাশনাল, নাকি সামিতাভেজ?
সকল
ক্ষেত্রে অপশনের বিস্ফোরণ; হোক সেটা নিত্য প্রয়োজন, ভোগ, কিংবা বিলাস।
*
বিশেষজ্ঞরা
বলছেন – অপশনের এই বিস্ফোরণ এক বড় সমস্যা, ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের জন্যই।
ভোক্তাদের
দিক থেকে সমস্যাটা কনফিউশন তথা বিভ্রান্তির। একটু আগে যেমন লিখলাম, ইউটিউবে কী
দেখবো, কোনটা দেখবো ভাবতে ভাবতে কিছুই দেখা হয় না। তেমনি, এত এত রেস্টুরেন্ট, এতো
এতো খাবার – ভাবতে ভাবতে অনেক সময় দেখা যায় খিদেটাই মরে যায়।
মার্কেটের
ডিসপ্লেতে এতো এতো জামা-জুতা, বাহার এবং বৈচিত্র্য; কাস্টমাররা কনফিউজড হয়ে
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এক মার্কেট থেকে অন্য মার্কেটে ঘুরছে, চষে বেড়াচ্ছে – তবুও
কিছু পছন্দ হচ্ছে না।
ভোক্তার
এই বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হচ্ছে ব্র্যান্ড।
চঞ্চল-অস্থির-অশান্ত মনের ভোক্তারা চোখ
বুলিয়ে, আলতো ছুঁয়ে, প্রাইস ট্যাগে টোকা দিয়ে খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে এক সারি থেকে
অন্য সারিতে। কাঙ্ক্ষিত আকর্ষণ তৈরি করতে পারছে না অনেক ব্র্যান্ড। বাজারে হাজারো
পসরার কোলাহল, কনফিউশন আর ইনোভেশনের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে অনেক ব্র্যান্ড।
ইকোনো, রাইটার, জাম্প কেডস, বেইলী কেডস, নিরালা সাবান, অ্যারোমেটিক হালাল সাবান,
লেমনডিউ, পেপস জেল টুথ পেস্ট, অথবা সিটিসেল কখন যে ‘নাই’ হয়ে গেল! নকিয়া, ইয়াহু,
ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়, মাসিক রহস্যপত্রিকা এবং
ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুল নিঁভু নিঁভু হয়ে আছে। তীব্র প্রতিযোগিতার দমকা ঝড়ো
হাওয়ায় কে কতোক্ষণ টিকবে সেটা অনিশ্চিত।
*
মার্কেটে
অপশনের বিস্ফোরণে টিকে থাকার উপায় কী?
অ্যাকাডেমিক
এবং প্র্যাকটিশনাররা অনেক আগেই বলেছেন – মূল উপায়, অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে হবে।
একটা পণ্য বা ব্র্যান্ড ‘মী ঠু’ তথা অন্য সবার মতো হয়ে গেলে বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলে।
ভোক্তার নজর আগ্রহ কিছু আর পায় না। ভোক্তার
কাছে অন্যদের চেয়ে আলাদা, মানে ইউনিক/অনন্য হয়ে ওঠা ছাড়া ব্র্যান্ডের বেঁচে থাকার
উপায় নেই।
সবার চেয়ে আলাদা হয়ে উঠলেই নজরে পড়বে |
এই
আলাদা হওয়ার ব্যাপারটিকে বইয়ের ভাষায় – ইউনিক সেলিং প্রপোজিশন/পয়েন্ট (ইউএসপি)
বলে। যখনি কেউ নতুন কোনো ব্র্যান্ড বা প্রোডাক্ট বাজারে আনতে চায়, একেবারে প্রথম
যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তা হলো – আপনার এই ব্র্যান্ডের/প্রোডাক্টের নতুনত্ব কী?
আপনি এমন কী অফার করবেন যেটা অন্যেরা অফার করছে না? কাস্টমাররা আপনার কাছ থেকে
নতুন কী এমন পাবে যেটা অন্যদের থেকে পাবে না? এসব প্রশ্নের মূল কথা হলো আপনার
অফারের ইউএসপি কী?
রজার রীভ (১৯১০-১৯৮৪) |
ইউনিক
সেলিং প্রপোজিশনের ধারণাটি খুব নতুন নয়। প্রায় ৬০ বছর আগে, ১৯৬০ সালে, মার্কেটিং
বিশেষজ্ঞ রজার রীভ এই ধারণার প্রস্তাব করেন। সে সময় বিজ্ঞাপনগুলো এতো বেশি
বিরক্তিকর, একঘেঁয়ে ছিল এবং সব কিছু এত বেশি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছিল (পাফারি) যে,
মানুষজন বিজ্ঞাপনের প্রতি ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে এক মেট্রিক টন বিতৃষ্ণা এবং অবিশ্বাস
নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো।
পরিস্থিতি
বিবেচনায় রজার রীভ পরামর্শ দিয়েছিলেন – প্রতিটি ব্র্যান্ড ইউনিক কিছু অফার করুক,
বিজ্ঞাপনে একেবারে মৌলিক কিছু বলুক; যেটা অন্যরা বলবে না বা অফার করবে না। কেবল,
বিশ্বাসযোগ্য ইউএসপি দিয়েই বিজ্ঞাপনের প্রতি ভোক্তার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এক্ষেত্রে তিনি ৩টি পয়েন্ট সুনির্দিষ্ট করেন –
১)
কেবল বাহারী কথামালা নয়, স্পষ্ট করে বলুন – এই ব্র্যান্ড/পণ্য কিনলে ভোক্তা কী
উপকার পাবেন।
২)
“ভ্যালু প্রপোজিশন” এমন ইউনিক হতে হবে যেন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীরা খুব সহজে সেটা
নকল করতে না পারে।
৩)
পণ্যের ভ্যালু প্রপোজিশন শক্তিশালী হতে হবে, যাতে করে সুবিশাল ভোক্তাসমাজ আপনার
পণ্যের দিকে আকৃষ্ট হয়।
রজারের
পরামর্শ বাজারীরা লুফে নিয়েছিল। গত ৫০ বছরের মার্কেটিং ইতিহাসে প্রতিটি সফল
ব্র্যান্ডিংয়ের পেছনে ইউএসপির ভূমিকা খুব সহজেই লক্ষ্যণীয়।
*
ইউনিক
সেলিং প্রপোজিশন ব্র্যান্ডগুলোকে একটু স্বস্তি দিলো, কিন্তু অফুরান শান্তি দিলো
না। বিশেষ করে, ১৯৯০র দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ইন্টারনেটের বিস্ফোরণ ঘটলো, আরো পরে
অনলাইন মার্কেট, ই-কর্মাস, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং সাইবার
স্পেসে গ্লোবাল কনজ্যুমার সোসাইটি তৈরি হলো, গ্লোবাল ট্রেড নতুন মাত্রা পেলো – তখন
ব্র্যান্ডগুলো কেবল লোকাল কম্পিটিটর নয়, ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশনের তীব্র চাপে
পড়লো।
এই
তীব্র প্রতিযোগিতায় আবারও ব্র্যান্ডগুলো চেষ্টা করলো অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা
করতে। নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা, অনন্য, এবং ব্যতিক্রম তথা ‘ডিফারেন্ট’ করার
ব্যাপারটিকে টেক্সট বুক ল্যাঙ্গুয়েজে ‘ডিফারেনশিয়েশন’ বলা হয়।
ব্র্যান্ড
বিশেষজ্ঞরা বলে – ডিফারেনশিয়েশনের ওপর ব্র্যান্ডের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। যদি
ডিফারেন্ট (আলাদা) হতে পারেন, তবেই বেঁচে থাকবেন...
প্রশ্ন
জাগতে পারে – একটা ব্র্যান্ড আলাদা হবে কীভাবে?
আমাদের
চারপাশে অনেক উদাহরণ।
শ্যাম্পুর
কথাই ধরি – কেউ বলছে খুশকী দূর করবে, কেউ বলছে ঘন-কালো-লম্বা চুল দেবে, কেউ বলছে
চুল পড়া কমাবে, কেউ বলছে উকুন দূর করবে, সিল্কি শাইনি চুল হবে, হিজাব ঢাকা
চুলে ঘামের গন্ধ কম হবে, কিংবা উসকুখুশকো চুলে ময়েশ্চারাইজার দেবে।
টুথপেস্টে
বহুকাল ধরে কলগেট বলছে পরিস্কার দাঁত ও সজীব নিঃশ্বাস দেবে, ক্রেস্ট ব্র্যান্ড
বলছে দাঁতের ক্ষয়রোধ হবে, সেনসোডাইন বলছে সেনসিটিভ দাঁতের শিরশিরানি ভাব কমাবে,
অধুনা ক্লোজ আপ বলছে – ‘কাছে এসো’ – আকারে ইংগিতে বলা হচ্ছে – গন্ধহীন মুখে কিসিং
আনন্দময় হবে।
একইরকমভাবে,
বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্য্য সাবানের ব্যাপক বিস্তার ঘটছিল যখন, ফুলের সৌরভ, সুবাস আর
সৌন্দর্য্যের প্রতিশ্রুতি যখন সাবানের মোড়কে বিক্রি হচ্ছিল, তখন লাইফবয় বললো স্টপ
ব্যাড অডর। আশির দশকে বাংলাদেশেই জনপ্রিয় জিঙ্গেল হয়ে উঠলো ‘স্বাস্থ্যকে রক্ষা করে
লাইফবয়’। রেডিও চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন তরঙ্গে ধ্বনিত হলো “লাইফবয় যেখানে,
স্বাস্থ্য সেখানে”। ভোক্তারা জানলো এবং বিশ্বাস করলো সুস্বাস্থ্যের জন্য কেবল
সুখাদ্য নয়, জীবাণুনাশক সাবানও প্রয়োজন।
পরের
দশকে ১৯৯৩/৯৪ সালের দিকে হালাল সাবান এনে অ্যারোমেটিক ব্র্যান্ড তোলপাড় করে দিলো।
সে আরেক ইতিহাস। সাবান খায় না, গায়ে মাখে; এবং সেটা হালাল হতে পারে – এ ধারণার
‘ডিফারেনশিয়েশন’ করে আনকোরা এক ব্র্যান্ড রাতারাতি বাজার দখল করে ফেললো। বড় ধাক্কা
খেলো লাক্স। তবে, কিছুটা বুদ্ধি দেখালো মেরিল বিউটি সোপ। সরাসরি ‘হালাল’ ট্যাগে না
গেলেও মেরিল বললো তাদের সাবান সম্পূর্ণ ভ্যাজিটেবল ফ্যাট থেকে তৈরি, এতে গরু কিংবা
শুকরের চর্বি নেই। ডিফারেনশিয়েশনে ধর্মানুভূতি প্রয়োগের আরেক মাত্রা দেখলো ভোক্তা
সমাজ।
ব্যাংকিং
সেক্টরে “শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং”ও ডিফারেনশিয়েশনের ভালো উদাহরণ।
*
তাত্ত্বিকভাবে,
সব কিছুকেই ‘আলাদা’ করা সম্ভব।
বিশেষ
বৈশিষ্ট্যের কারণে আলাদা হয়ে যেতে পারে কলা; যেনতেন কলা নয় – কেমিক্যালমুক্ত কলা।
(সু)নামের
কারণেও ব্র্যান্ড আলাদা হয়ে ওঠে শুধু হালিম নয়, এটা মামা হালিম।
অথবা মোস্তাকিমের
চাপ, নান্নার বিরিয়ানি, রাব্বানী হোটেলের গরু গোশত, এবং নীরব হোটেলের ভর্তা। মাম-অ্যাকুয়াফিনা-কিনলে বিশুদ্ধ
পানি। মামের ব্যাপক ডিস্ট্রিবিউশন, অ্যাকুয়াফিনার প্যারেন্ট ব্র্যান্ড পেপসি, এবং
কোকাকোলার কিনলে; এসবই বিজ্ঞাপন ও বিপননের ফলে সৃষ্ট সুনামভিত্তিক ডিফারেনশিয়েশনের
সুবিধাভোগী।
*
ডিফারেনশিয়েশনের
আরেক ফর্মুলা হলো – ইম্প্রুভ, আপগ্রেড, ইনোভেট।
বর্তমানে
বাজারে (একটু কম) চলছে এমন পণ্যকে ফাইন টিউনিং করেও ডিফারেনশিয়েশন করা যায়। জিলেট
রেজরের ফিউশনিং দারুণ এক উদাহরণ। সাদামাটা এক ব্লেডের রেজর যখন একঘেঁয়ে হয়ে
যাচ্ছিল, জিলেট ক্রমান্বয়ে দুই, তিন, চার এবং ৫ ব্লেডের রেজর এনে অন্যদের চেয়ে
আলাদা হয়ে উঠলো। নতুন জীবন লাভ করলো।
টুথপেস্ট
বাজারে আনার ২৭ বছর পরে টুথব্রাশ এনেছিল ওরাল-বি। ১৫০ জনের রিসার্চ টীম দীর্ঘ
যাচাই বাছাইয়ের পরে বাজারে এনেছিল বিশেষ ফাইবারের ব্রিসলওয়ালা টুথব্রাশ, যার
ইউএসপি ছিল “এই টুথব্রাশ আপনার দাঁতে জমে থাকা পাথর সরাবে”।
ভলভো
কার সেইফটির জন্য বিখ্যাত হয়েছে সাইড ডোর এয়ারব্যাগ, রানিং লাইটের মতো নতুন সেইফটি
ফিচার এনে।
গত
দুই দশকে ঢাকা শহরেই আমরা দেখেছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন নতুন ইউএসপি – যেমন,
“ধুমপান ও রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ”, “এই কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট
পড়তে হয় না” অথবা “এসিবিএসপি অ্যাক্রিডিটেড বিজনেস স্কুল”।
তবে
খেয়াল করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ ইউএসপি খুব দ্রুত কপি হয়ে যায়। ইউএসপি কনসেপ্টের
জনক রজার রীভের ৩ টি পয়েন্টের ২ নম্বর পয়েন্টে আবার নজর দিতে পারেন।
*
ইম্প্রুভ-আপগ্রেড-ইনোভেশনের
বাইরে কাস্টমার সার্ভিস দিয়ে, বিশেষ করে সেবা খাতে, ডিফারেনশিয়েশন করা যায়।
প্রশিক্ষিত, স্মিত, সৌম্য, সভ্য কর্মীরা অনায়াসে কাস্টমারের মন জয় করে নিতে পারে।
এবং নিজেদের সার্ভিস ব্র্যান্ডকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করতে পারে।
Aadvantage লয়ালিটি প্রোগ্রাম |
তাহলে
আমরা দেখছি যে, ডিফারেনশিয়েশনের মাধ্যমে কাস্টমার স্যাটিসফেকশনও বাড়ানো যায়।
সন্তুষ্ট ভোক্তাদের ধরে রাখা সহজ। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ’র এক গবেষণামতে,
কাস্টমার সুইচিং (পল্টি খাওয়া) ৫% কমাতে পারলে কমপক্ষে ২৫% প্রফিট বাড়ে। এ কারণে,
কাস্টমারদের একদিকে যেমন কিং বলা হয়, আবার বাটারফ্লাইও বলা হয়। পল্টি খাওয়া
কাস্টমার প্রজাপতির মতো এক ফুল (ব্র্যান্ড) থেকে অন্য ফুলে (ব্র্যান্ডে) ঘুরে ঘুরে
মধু খেয়ে চলে যায়। লয়্যাল হয় না। স্বভাবতঃই আমরা অনেক ব্র্যান্ডকে লয়ালিটি
প্রোগ্রাম অফার করতে দেখি। মার্কেটিং ইতিহাসে অ্যামেরিকান এয়ারলাইন্সের Aadvantage প্রোগ্রামের
মাধ্যমে মাইলেজ দেয়ার লয়ালিটি টেকনিকও ইউনিক কিছু থাকেনি। অন্য এয়ারলাইন্স কপি করে
নিয়েছে খুব দ্রুত।
*
ঠিক
এ জায়গায় প্রশ্ন আসে – স্যাটিসফ্যাকশনের মাধ্যমে যদি লয়ালিটি তৈরি করা যায়, তাহলে
ইউএসপির আর কী দরকার?
ভালো
প্রশ্ন। কিন্তু, স্যাটিসফ্যাকশন মানেই কি লয়াল থাকার প্রতিজ্ঞা? ১৯৯০র দশকে একটা
মার্কেটিং মীথ ছিল – “কাস্টমার সার্ভিসই রিয়েল গেইম”। সেসময় অনেক ব্র্যান্ড ভুলে
গিয়েছিল, মার্কেটিং কেবল কোম্পানী-কাস্টমারের দ্বিপাক্ষিক দাবা খেলা নয়। সে খেলার
মাঠে দর্শক নয় এবং খেলোয়াড় হিসেবে আছে আরো কয়েক ডজন ব্র্যান্ড।
খেলোয়াড়দের
(কোম্পানীর) মাঝে মাঠ (বাজার) দখলের এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কারণে, বাজারে
অফুরন্ত অফারের বিস্ফোরণ ঘটে; ফলে, সন্তুষ্ট ভোক্তারাও শেষ বিচারে লয়াল থাকে না।
প্রজাপতির মতো উড়ে যাওয়া কাস্টমারদের ধরে রাখার অন্যতম উপায় হলো – অনন্য ফুল ও মধু
(ইউনিক প্রোডাক্ট) অফার করতে হবে যেটা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। ঠিক একারণেই,
কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশনের পাশাপাশি শক্তিশালী ইউএসপি তৈরি করা প্রয়োজন।
*
ক্রিয়েটিভ
টিম ব্র্যান্ডের জন্য ইউএসপি তৈরি করলো। কিন্তু, সেটা কাস্টমারের সাথে কম্যুনিকেট
করা হবে কীভাবে?
ইউএসপি
প্রচারের অন্যতম ক্ষেত্র হলো বিজ্ঞাপন। যেমন, পেপসোডেন্ট বিজ্ঞাপনের শেষে টুপ করে
বলেছিল “পেপসোডেন্ট, বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির অনুমোদনপ্রাপ্ত একমাত্র টুথপেস্ট”।
বিজ্ঞাপনের
একটা চিরায়ত সমস্যা আছে, সেটা হলো ‘ওভারলোডেড ক্রিয়েটিভিটি’। মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনের
ভেতরে গল্প-নাটকীয়তা-সাসপেন্স এবং সেক্স এতো বেশী থাকে যে বিজ্ঞাপনটি বিনোদন হয়ে
ওঠে। মূল ইউএসপি ঘোলাটে হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো
– KISS (Keep it short
and simple) স্ট্র্যাটেজি ফলো করতে হবে। এই কোলাহলপূর্ণ বাজারে অল্প
করে বলাটাই বেশি বলা।
ইউএসপির
সাথে মিল আছে এমন আরেকটি কনসেপ্ট হলো পয়েন্ট অব ডিফারেন্স। ব্র্যান্ডিং গুরু
কেলভিন কেলার ব্র্যান্ড পজিশনিং-এর ক্ষেত্রে পয়েন্ট অব প্যারিটি এবং পয়েন্ট অব
ডিফারেন্স নামক দুটি ধারণার কথা বলেন।
ইউএসপির
সাথে পয়েন্ট অব ডিফারেন্সের মিল এখানেই যে দুটো কনসেপ্টই ব্র্যান্ডকে অন্যদের চেয়ে
আলাদা অনন্য হয়ে ওঠার কথা বলে। খেয়াল রাখা প্রয়োজন, ইউএসপি/পয়েন্ট-অব-ডিফারেন্স
ব্র্যান্ডের স্লোগান থেকে আলাদা বিষয়। অনেকেই এই দুই কনসেপ্টে গোলমাল বাঁধিয়ে
ফেলে। কিছু উদাহরণ দেখা যাক –
গ্রামীণ
ফোন “কাছে থাকুন” থেকে “চলো বহুদূর” স্লোগান পাল্টালেও তাদের মূল ডিফারেনশিয়েশন
পয়েন্ট ছিল – "দেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল নেটওয়ার্ক"। উল্লেখ্য, "কাছে থাকুন" বা "চলো
বহুদূর" গ্রামীণ ফোনকে তার কম্পিটিং ব্র্যান্ড থেকে আলাদা করে না। বরং "দেশের
সর্ববৃহৎ মোবাইল নেটওয়ার্ক" কাস্টমারের মনে এই ধারনা দেয় যে, জিপির নেটওয়ার্ক সারা
দেশে বিস্তৃত এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সিগন্যাল পাওয়া যাবে।
মার্কেটিং
এর ইতিহাসে জনপ্রিয়তম স্লোগানদের একটি হলো নাইকির ‘Just do it’। লক্ষ্য করুন – এটা স্রেফ স্লোগান। এই নিরীহ স্লোগান নাইকিকে
তার প্রতিযোগী ব্র্যান্ড থেকে আলাদা করে না। তাহলে নাইকির ইউএসপি বা ডিফারেনশিয়েশন
কী?
নাইকির
অতীত ঘাটলে দেখা যায় ৪ হাজারের বেশি নামকরা অ্যাথলেট নাইকির প্রচার প্রসারে
বিজ্ঞাপনে সামিল হয়েছে। মাইকেল জর্ডান, টাইগারউড, রজার ফেদেরার – কে নেই? যে কোনো
খেলার দিকে তাকান, দেখবেন – কোনো না কোনো তারকা খেলোয়াড়ের জুতায়-জামায়-ক্যাপে বা
রিস্টব্যান্ডে নাইকির লোগো ঝিলিক দিচ্ছে।
নাইকির
স্ট্র্যাটেজী পরিস্কার – বিশ্বের সেরা অ্যাথলেটরা কোন ব্র্যান্ড পরছে?
নাইকি।
তাহলে
তারকা অ্যাথলেটদের লক্ষ কোটি ভক্তরা নাইকিই কিনবে, পরবে।
একইভাবে,
ম্যাকডোনাল্ডসের I am
loving it স্লোগান হিসাবে চমৎকার। কিন্তু, ম্যাকডোনাল্ডস যখন নিজেকে
দাবী করে The world’s favorite place to eat- তখন
ম্যাকডোনাল্ডস অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে ওঠে।
*
এ
পর্যন্ত আমরা দেখলাম, ভ্যালু প্রপোজিশনের পাশাপাশি পণ্যের স্টাইল-ফিচার-ডিজাইন
এবং সেবার মান দিয়ে ডিফারেনশিয়েশন তৈরি করা যায়। এখন প্রশ্ন – দাম কমিয়ে বাড়িয়েও
কি অন্যদের থেকে নিজের ব্র্যান্ডকে আলাদা করা যায়?
হ্যাঁ,
যায়।
তবে
সতর্ক থাকা প্রয়োজন – কম্পিটিটররা যেন সেইম গেইম খেলতে না পারে।
কয়েকটা
উদাহরণ ধরা যাক, বাজেট এয়ারলাইন্সের কথাই ধরি। যেমন, রায়ান এয়ার বা এয়ার এশিয়া।
এরা লো-কস্ট এয়ার লাইন্স। কমপ্লিমেন্টারি খাবার নেই, লাগেজ নেই, বালিশ নেই, চাদর
নেই, এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থাও নেই। কাস্টমারদের সব কিছু আলাদা আলাদা করে কিনতে
হয়। এটাই বাজেট এয়ারের বিজনেস পলিসি। কম দাম বলে, ব্যাপক কাস্টমারের ভীড়। অথচ, ‘সস্তার
তিন অবস্থা’ নয়। বেসিক সার্ভিস কোয়ালিটি মেনটেইন করা হয়। সময় মতো ফ্লাইট ছাড়ে,
লাগেজ হ্যান্ডলিং ঠিক মতো করা হয়। মূল কথা, দাম কম হতে পারে, তাতে সেবা যেন নিম্ন
মানের না হয়। বেসিক ভ্যালু প্রপোজিশন নিশ্চিত করার কারণেই বাজেট এয়ারলাইন্সগুলো
সাফল্যের মুখ দেখে।
একইভাবে
উদাহরণ টানা যায় – Everyday
low price এর ওয়ালমার্টের কথা। কম দামের কারণেই অন্যদের চেয়ে আলাদা।
তবে
দাম কমিয়ে অন্যদের চেয়ে আলাদা হওয়া রিস্কিও বটে। ছোট ও মাঝারি ব্র্যান্ড যদি দাম কমিয়ে
মার্কেট পাওয়ার চেষ্টা করে, তবে মার্কেট লিডার যে কোনো মুহূর্তে বিশাল ডিসকাউন্ট
দিয়ে পালটা আঘাত করতে পারে (এ বিষয়ে আলাদা লেখা আসবে আগামীতে)।
দাম
কমানোর আরেক সমস্যা হলো – সুযোগ সন্ধানী কাস্টমাররা এসে ভীড় করে। অন্য কোনো ব্র্যান্ড
আরো কম দাম অফার করলে, সেখানে সুইচ করে; স্রেফ বাটারফ্লাই কাস্টমার। অপরচুনিস্ট!
অন্যদিকে,
বেশি দাম রেখে আলাদা হওয়ার সুযোগ এবং সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশ্বের লাক্সারী
ব্র্যান্ডিং সেক্টর গড়ে উঠেছে এই বেশি দামের বিশেষত্বের কারণে। ল্যুই ভুইটন, গুচি,
আরমানি, রোলেক্স, রোলস রয়েস; এগুলো এত বেশি দামী, এক্সক্লুসিভ যে কেবল সুপাররিচ
কাস্টমাররাই কিনতে পারে...। বেশি দাম রাখার ব্যাপারে লাক্সারী ব্র্যান্ডের কোনো
দ্বিধা-সংকোচ নেই। বরং বেশি দামটাই লাক্সারী ব্র্যান্ডের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাই, Joy পারফিউম নিসংকোচে
বলতে পারে – “The costliest perfume in the world”
Joy পারফিউমের বিজ্ঞাপন |
লক্ষণীয়,
এসব লাক্সারী ব্র্যান্ড কেবল হাই কোয়ালিটি মেনটেইন করে তা না, বরং এক্সক্লুসিভিটি,
রেয়ারিটি এবং ক্রাফটম্যানশীপের জন্য ভোক্তারা সমাজে আলাদা একটা মান-মর্যাদা ও
প্রতিপত্তি লাভ করে। লাক্সারী আর নন-লাক্সারী ব্র্যান্ডের মাঝামাঝি দামে প্রিমিয়াম,
প্রেস্টিজ ও হাই-এন্ড ব্র্যান্ডের উপস্থিতি বাজারে দেখতে পাওয়া যায়। এটাও
দাম-ভিত্তিক ডিফারেনশিয়েশনের একটা উদাহরণ।
*
এ
হলো ব্র্যান্ডের ডিফারেনশিয়েশন নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের কথাবার্তা। এ বিষয়ে আরো এক
কিস্তি লেখা আসবে। সেখানে আমরা ডিফারেনশিয়েশনের এক ডজন উপায় এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে
আলোচনা করবো।
*
*
*
নোট
–
এ
লেখার মূল ভিত্তি রাইজ অ্যান্ড ট্রাউটের বই - ডিফারেনশিয়েট অর ডাই। কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত, প্রশ্ন, ভাবনা জানান। আলোচনা করুন, সমালোচনা
করুন, লেখাটি শেয়ার করুন। ব্র্যান্ড, কনজ্যুমার ও বিজ্ঞাপন বিষয়ে ভাবনার জগত
বিস্তৃত হোক...
Very nice writing in bengali. Thank you.
ReplyDeleteMany thanks for your kind comment. Please follow our Facebook page for regular updates.
Deleteঅসাধারণ স্যার,সবগুলো লেখা পড়ে ফেলেছি।আরো লেখা আসবে বলে প্রতিক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteঅপ্রা