বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ দলের জার্সি উন্মোচিত হয়েছে। এরপর
ঝড় বয়ে গেছে। বিশেষতঃ সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনদের তীব্র সমালোচনার মুখে জার্সির রঙ
বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। এ সিদ্ধান্তের পরপরই
আলোচনা সমালোচনার ঝড় থামতে পারতো, কিন্তু থামেনি। ঝড়ের পরে যেমন ঝরা পাতা পড়ে
থাকে; বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ থাকে তেমনি – অনলাইনে আলোচনার রেশ রয়ে গেছে।
তবে এ সংক্রান্ত (আপত্তিকর) ট্রলিং এবং যুক্তির সীমা ও মাত্রা বিবেচনা করে
বিজ্ঞামনের এ লেখা। বাংলাদেশ ক্রিকেট জার্সি বিতর্কের রাজনৈতিক ও মনোজাগতিক
দিকগুলো স্বল্প পরিসরে আলাপ থাকছে এ লেখায়।
খেলা হবে!
খেলা হবে মাঠে। বোলার বনাম ব্যাটসম্যান। কব্জির জোর আর ক্রিকেটমেধার মিশ্রনে
কে কাকে হারাবে, কে শিরোপা হাতে নিবে; সেটাই মূখ্য আলোচ্য হওয়ার কথা। কিন্তু সে সব
বাদ দিয়ে খেলোয়াড়দের জার্সির রঙ কেন আলোচ্য হলো?
উত্তরটা সহজ।
জার্সির রঙ হলো দলের পরিচয় চিহ্নের অন্যতম। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই
আইডেন্টিটি এলিমেন্ট দর্শকের চোখে মনে গেঁথে থাকে। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের কথাই
ভাবুন – হলুদ ছাড়া অন্য কোনো রঙ কি মনে ভাসে? যেমন করেই খয়েরী রঙ মিশে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
দলে। একই রকমভাবে গত ২৫ বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যে ‘ইমেজ’ বা প্রতিচ্ছবি –
সেখানে সবুজ ছাড়া অন্য কোনো রঙ কি মনে আসে?
পাকিস্তানের সাথে জার্সির মিল |
পাকিস্তান এবং আয়ারল্যান্ডের জার্সিও সবুজ। এতকাল তাহলে সবুজ নিয়ে প্রশ্ন
ওঠেনি কেন? ভারত ও শ্রী লংকার জার্সি নীল; সে নীল নিয়ে কি বিতর্ক হয়েছে কখনো?
মুশকিলটা সম্ভবতঃ এখানেই যে রঙের ব্যাপারটা ধ্রুব কোনো ধারণা নয়। রঙের বাহারে,
রঙের মধ্যেও রঙ থাকে। তীব্রতার ভিন্নতা থাকে। তাই সবুজ কেবল সবুজ নয়; সবুজ হয়ে ওঠে
ঘন সবুজ, গাঢ় সবুজ, হাল্কা সবুজ, আকাশী সবুজ, কিংবা ধুসর চা সবুজ।
বাংলাদেশের সবুজ এবং পাকিস্তান-আয়ারল্যান্ডের সবুজ এতদিন ধরে আলাদা ছিল।
কিন্তু এবারের বিতর্কিত জার্সি সেই আলাদা ধরণকে এক করে দিয়েছে। বাংলাদেশের জার্সির
মধ্যে যে গাঢ় সবুজকে আমরা দেখতে চাই, সে সবুজ আমাদের পতাকার সবুজ, আমাদের পাসপোর্টের
সবুজ। ক্ষেত্র বিশেষে সবুজের তীব্রতায় ভিন্নতা আসতে পারে, আগেও এসেছে। সমস্যা
হচ্ছে - এবারের বাংলাদেশের সবুজ হয়ে গেছে পাকিস্তানের সবুজ।
রঙের রাজনীতি
বাংলাদেশের জার্সিতে আমরা পাকিস্তানী সবুজ ইমেজ দেখতে চাই না কেন?
প্রথমতঃ পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের রক্তাক্ত অতীত জড়িত। পাকিস্তানের সাথে ৯
মাসের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি; লাল সবুজের পতাকা
পেয়েছি। ১৯৭১-এর জন্য পাকিস্তান নামক বর্বর রাষ্ট্রটি এখনো ক্ষমা চায়নি। অর্থনীতি
আর বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমাগত ব্যর্থতায় ডুবে যাওয়া পাকিস্তানের দিকে আমরা চেয়ে থাকি
না। বাংলাদেশ এগিয়েছে, বাংলাদেশ এগুবে। তবে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকায় তাকিয়ে
১৯৭১ এবং পাকিস্তানের নৃশংসতাকে ভুলে থাকা যাবে না; এটাই বাস্তবতা। এটাই ঐতিহাসিক
সত্য। এটাই মীমাংসিত সত্য। এ সত্য নিয়ে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব বা সন্দেহের অবকাশ
নেই।
সুতরাং, পাকিস্তানের জার্সির সঙ্গে অবিশ্বাস্যরকমভাবে মিলে যাওয়া বাংলাদেশের
জার্সি দেখে প্রতিক্রিয়া দেখানোই স্বাভাবিক। এই প্রতিবাদের পেছনে আবেগ আছে, ইতিহাস
আছে, দেশপ্রেম আছে, ১৯৭১-এর চেতনা আছে। এই ‘চেতনা’ শব্দটি নিয়ে যাদের এলার্জি আছে –
যারা বাংলাদেশের পাসপোর্টের পাশে পাকিস্তানের পাসপোর্ট রেখে ট্রলিং করেন, তারা সচেতনে/অচেতনে
কাদের পারপাস সার্ভ করছেন হয়তো তারা নিজেরাই জানেন না।
তর্কের শুরু যখন হয়, তখন কুতর্কের জোয়ার আসে। এবার আমরা দেখলাম, সেই কুতর্কের
জোয়ারে ট্রলিং-প্রিয় নেটিজেনরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেভাবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে
সবুজাভায় মিলিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে নানান সময়ে বিদ্রুপ
করা রমিজ রাজা – রশিদ লতিফ – জাভেদ মিয়াদাদ আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা নিশ্চয়ই ব্যাপক
পুলকিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, জার্সির রঙ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দিকটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়া বিসিবি
কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও নিন্দনীয়। তারা সতর্ক থাকলে এই তর্কের জন্মই হতো না। লাল-সবুজের
তরমুজকে জাতীয় ফল করার মতো সস্তারুচির ট্রলিং হতো না।
রাজনৈতিক কুতর্কের আগুনে ফুঁ না দিয়ে, জার্সিতে রঙের রাজনীতি নিয়ে আলাপ এই
পোস্টে এখানেই শেষ হতে পারে।
রঙের মনোজগত
জার্সির রঙ নিয়ে গণমানুষের মনোজাগতিক দিক দেখা যাক। সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে মানুষের প্রতিক্রিয়ায় যে ক’টি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তা হলো, বেশিরভাগ মানুষ
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সিতে
১) সবুজ দেখতে চায়
২) লাল দেখতে চায়
৩) বাঘের ডোরাকাটা দাগ দেখতে চায়
প্রশ্ন জাগে – মানুষ কেন লাল সবুজ দেখতে চায়? কেন বাঘের ডোরাকাটা দাগ দেখতে
চায় জার্সিতে? বাংলাদেশ দলের জার্সি কেমন হবে সেটা নিয়ে কোনো জনমত জরিপ কি হয়েছিল
কখনো? খুব সম্ভবতঃ ১৯৯৯ সালের জার্সি ডিজাইনার প্রচ্ছদ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে যেতে
পারে – কী ছিল গাইডলাইন? বিসিবি-ই বা ডিজাইনারদের থেকে কী প্রত্যাশা করে?
তবে জার্সিতে লাল সবুজ দেখার আকাঙ্ক্ষার পেছনে দেশপ্রেম আছে। বাঘের ডোরাকাটা
দাগ দেখার পেছনে বাংলাদেশ টীমের ‘টাইগার’ ব্র্যান্ডিং আছে। জার্সিতে লাল সবুজ রঙ
এবং বাঘের ডোরাকাটা দাগ দেখার আকাঙ্ক্ষা (desire) একদিনে হয়নি। এখানে দেখার এবং
অভ্যস্ততার (familiarity) এবং পছন্দের (likeability) ব্যাপার
আছে।
ফলে লাল-সবুজ এবং বাঘের ডোরাকাটা দাগ – এ তিন বিষয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের
পরিচয়চিহ্ন (identity) হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে যদি একটি ব্র্যান্ড
হিসেবে ধরি, এই মুহূর্তে ম্যাশ-তামিম-সাকিব-মুশি-মাহমুদুল্লাহ যেমন এই ব্র্যান্ডের
পারফর্মার, তেমনি লাল-সবুজ-বাঘ হচ্ছে দলের ব্র্যান্ড এলিমেন্ট (উপকরণ)। এই তিনটি
এলিমেন্টই বাংলাদেশ দলকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে রাখে। যাবতীয় মার্কেটিং
কম্যুনিকেশনে এই ব্র্যান্ড এলিমেন্টগুলোকে সমন্বয় করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে – জিম্বাবুয়ে/কেনিয়ার জার্সিতে লাল সবুজ
ছিল/আছে। তাহলে বাংলাদেশের জার্সির লাল সবুজের মৌলিকত্ব কোথায়? ঠিক এখানেই ট্রলার
সোসাইটির দেখার ও বোঝার সীমাবদ্ধতা। ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি কেবল রঙে আসে না; রঙের
অর্থবহ ব্যবহার ও মিশ্রণ লাগে। লাল সবুজ থাকা মানেই বাংলাদেশ নয়। কেবল নীল থাকলেই
গ্রামীণ ফোন হয় না। কেএফসি, পিজ্জা হাট, এয়ারটেল এবং রবি; এদের সবার রঙ লাল,
কিন্তু প্রয়োগের অর্থ এবং সংশ্লিষ্টতা ভিন্ন, তাই ব্র্যান্ডগুলোও ভিন্ন হয়ে ওঠে।
যেমন ভিন্ন হয়ে ওঠে সবুজ রঙের সেভেন আপ এবং স্প্রাইট।
কেনিয়ার লাল সবুজের তীব্রতা এবং মিশ্রণ বাংলাদেশের লাল সবুজ থেকে আলাদা ছিল।
তাই কেনিয়াকে কেনিয়াই মনে হয়েছে, বাংলাদেশ মনে হয়নি। আকরাম-বুলবুল-দূর্জয়দের
জার্সিতে বাঘের যে ডোরকাটা দাগ ছিল – সেটা বাংলালিংকের লোগোর ডোরাকাটা দাগ থেকে
আলাদা। তাই, নতুন কোনো জার্সিতে বাঘের ডোরাকাটা বসাতে গেলে সতর্ক থাকতে হবে সেটা
যেন বাংলালিংক না হয়ে যায়।
মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্র্যান্ডের ইন্দ্রীয় জগতে (sensory world) যেসব
এলিমেন্ট থাকে – লোগো, রঙ, ডিজাইন, কারেক্টার – সেগুলো অনেকটা পিয়ানোর কীবোর্ডের
মতো। যথাযথ সুত্র মেনে সারেগামার মিশ্রণ করলেই সুরের ঝংকার তৈরি হবে, শ্রোতার কাছে
মনোগ্রাহী হবে। ভোক্তার চোখ-মন জয় করার যুদ্ধই চিরায়ত ব্র্যান্ড ওয়ার।
বইয়ের জার্গন বাদ দিয়ে সহজ বাংলায় এভাবে বলা যায় –
কেএফসির চিকেন ফ্রাইতে, ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানিতে, বিয়েবাড়ির রেজালায়,
নীলক্ষেতের তেহারীতে, বিএফসির বার্গারে কিংবা নান্দোজের পেরিপেরিতে চিকেন পাওয়া
যায়। ন্যুনতম বিবেচনাসম্পন্ন মানুষ মাত্রই একমত হবেন – উল্লেখিত আধা ডজন রেসিপির
প্রতিটির চিকেন আলাদা। কেউ যদি কেএফসির চিকেন ফ্রাই ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি ভাতে
মেশায়; এক নজর দেখেই বলা যাবে এটা বিরিয়ানির মাংশ না।
একই ব্যাপার ঘটেছে সাম্প্রতিক জার্সিকান্ডে। এই জার্সিতে বাংলাদেশের অনুপস্থিতি
এবং পাকিস্তানের উপস্থিতি দুটোই যুগপৎ ঘটেছে। জার্সিটিতে “বাংলাদেশ” শব্দটি তুলে
দিয়ে চাঁদ তারা বসালেই পাকিস্তানের জার্সি হয়ে যায়। অথচ লোগো পাল্টালেও স্প্রাইট
এবং সেভেন আপের সবুজ এক হয় না; আলাদাই থাকে।
বাংলাদেশের জার্সিতে পাকিস্তানের রূপ প্রথমে আঘাত হেনেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের
মনোজগতে। তারপর যোগ হয়েছে ইতিহাস, রাজনীতি এবং অশোভন ট্রলিং।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গত ২৫ বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যে ব্র্যান্ড ইমেজ
দর্শকদের মনে তৈরি হয়েছে – আলোচ্য জার্সিটিতে সেই ‘পারসেপশন’ প্রতিফলিত হয়নি। সাইকোলজির
টেক্স বইতে ব্যাক্তির পারসেপশনের ক্ষেত্রে এক্সপেক্টেশন, ফিমিলিয়ারিটি, এবং
হ্যাবিচুয়েশনের কথা বলা হয়। বিতর্কিত জার্সিটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের
জানাশোনার, প্রত্যাশার, এবং অভ্যস্ততার বিপরীত স্রোতে পাল তুলেছে। ফলে বৈরী ঢেউ
লেগেছে তাদের মনোজগতে।
মার্কেটিং ৩৩৭ থেকে ৪৬৫
বিসিবি’র মার্কেটিং প্রমোশন যারা দেখাশোনা করেন তাদের বুঝতে হবে মানুষের এই
প্রতিক্রিয়া যতোটা রাজনৈতিক, তারচে’ বেশি মনোজাগতিক। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টাইগার ‘ব্র্যান্ডিং’
পেয়েছে, সেটা যথেষ্ট নয়। এই টাইগার ব্র্যান্ডের এলিমেন্ট তথা উপকরণ কী কী হতে পারে
সেটা ঠিক করতে হবে।
মানুষ যদি লাল-সবুজ-বাঘ দেখতে চায়, সেটা বিবেচনায় নিয়ে, উপকরণগুলোকে অর্থবহ
এবং যথাযথ মিশ্রণে বাংলাদেশ দলের ইউনিক এবং এক্সক্লুসিভ ইমেজ তৈরি করা এবং তা ধরে
রাখার দায়িত্ব বিসিবিকেই নিতে হবে। মাঠে টাইগারদের হুংকার এবং গ্যালারীতে টাইগার ভক্তদের
উল্লাসে যেন লাল সবুজের বাংলার জয়ধ্বনি ওঠে।
খামখেয়ালি করে অন্যদেশের জার্সির সাথে মিলে যাওয়া এবং
সেটা প্রত্যাহার করা একটা স্মার্ট এবং সচেতন ক্রিকেট সংস্থার জন্য বিব্রতকর এবং
অপেশাদার।
তাই জার্সি নির্বাচন থেকে শুরু করে যাবতীয় মার্কেটিং
কম্যুনিকেশনে ব্র্যান্ড এলিমেন্টের সঙ্গতিপূর্ণ প্রয়োগ খুব প্রয়োজন।
ইমেজটা টাইগারদের, বাংলাদেশের।
ক্রিকেটের যথাযথ ইমেজ তৈরি এবং ধরে রাখার দায়িত্ব
বিসিবিকেই নিতে হবে।
No comments:
Post a Comment